এ কোন্ রাজনীতি ! লায়লা by নাজনীন হারুন

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে পথ দিয়ে সচরাচর যাওয়া-আসা করতেন, এক হিংসুটে বুড়ি সে পথে সর্বদাই কাঁটা বিছিয়ে রাখত, যেন নবীজীর পায়ে কাঁটার আঘাত লাগে অথবা সে পথ দিয়ে তিনি যাওয়া-আসা করতে না পারেন।
কিন্তু সেই বুদ্ধিহীন হিংসুটে বুড়ি কখনই ধারণা করতে পারেনি যে, নবীজী প্রতিদিন নিজের হাতে কাঁটা সরিয়ে সেই পথ দিয়েই নির্বিঘ্নে যাওয়া-আসা করতে পারবেন। মহানবীর বুদ্ধি ও বিচণতায় একদিন সেই হিংসুটে বুড়ি নিজেই বোকা বনে যায় এবং নিজের হিংসা ও নিবর্ুদ্ধিতার জন্য বুড়ি অনুতপ্ত হয়। ইতিহাসের এই অকাট্য সত্যটা আমরা কম-বেশি সকলেই জানি। মহামানব মহানবীর সঙ্গে পৃথিবীর কোন মানুষেরই তুলনা চলে না। শুধু এটুকু বলা যায়, কারও শুভ কর্মকাণ্ডের পথে হীনম্মন্যতাবশত কেউ কাঁটা বিছালে নিজের কাঁটায় নিজেরই তবিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এটা প্রমাণিত।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রাক্কালে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার এহেন বিবেকবর্জিত উক্তিগুলো শ্রবণ করে সারা দেশবাসী অবাক-বিস্মিত হয়ে যায়। তিনি বলেছেন : "প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে যদি দেশের স্বার্থরা না করে তিনি ফিরে আসেন তাহলে তাঁর ফেরার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেয়া হবে"। এ ধরনের উক্তি কোন সুশিতি, মার্জিত এবং বিবেকবান মানুষের মুখে উচ্চারিত হবার কথা নয়। এ ধরনের উক্তি এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধেরই কারণ বলে বিবেচিত হয়। বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দিতেও পিছ-পা হননি। তিনি অহঙ্কারী তর্জনি উঁচিয়ে আরও বলেছেন : "প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে সম্মতি দিলে এবং ট্রানজিট চুক্তি স্বার করলে সারাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে"।
অতীতেও দৃশ্যত প্রমাণিত হয়েছে ধর্মান্ধতার বশবতর্ী হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএনপি-জামায়াত গং ভারত বিরোধিতাই অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও দুই দেশের সুসম্পর্ক অতীব প্রয়োজন। দু'টি দেশই তাদের মধ্যে সুসম্পর্কের জন্য নিজেরাই উপকৃত হতে পারে। যে কোন উন্নত দেশ ও উন্নয়নকামী দেশের বিরোধী দল ও দলের প্রধানের কাছে দেশবাসী অনেক গঠনমূলক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য আশা করে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রায়শই এহেন রুচিহীন বক্তব্য দিয়ে তিনি তাঁর নিজের ইমেজটাকে এতদিনে কোথায় নামিয়ে এনেছেন তা কি তিনি ভেবে দেখেছেন? অতীতেও তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় বক্তব্য দানকালে চড়া গলায় বলেছেন : "আপনারা যদি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে মতায় আনেন তাহলে অচিরেই মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শুনতে পাবেন, বিসমিল্লাহ বলে কিছু থাকবে না। _ইত্যাদি কুরুচিসম্পন্ন কথা বলে খালেদা জিয়া দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছেন। কিন্তু যে দেশের মানুষ ভাল-মন্দ, সত্য ও ন্যায়কে চিনতে ভুল করে না, যে দেশের মানুষ '৭১-এ একটা সুগঠিত সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বীরদর্পে লড়াই করে প্রিয় স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল, সে জাতিকে মিথ্যা ও বানোয়াট কিছু বলে আর বিভ্রান্ত বা বিশ্বাস করানো যাবে না। এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের সপরে শক্তিকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে জাতি আবার প্রমাণ করেছে_ মিথ্যা ও অন্যায়কে কখনই মানা যায় না। একটি সরকার গঠিত হওয়ার মাত্র এক বছর সময়কালের মধ্যেই তাদের সাফল্যের পাল্লা ভারি হবে এমন ভাবা ঠিক নয়। ভাল-মন্দ মিলিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারাটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। প্রধানমন্ত্রী তো বার বারই বলে যাচ্ছেন, "দিন বদলের জন্য পাড়ি দিতে হবে অনেক দুর্গম পথ"। যে কোন সরকারকেই এক বছর কাল ধরা হয় মধুচন্দ্রিমাকাল হিসাবে। কিন্তু সেই মধু চন্দ্রিমাকালেই মহাজোট সরকারকে পাড়ি দিতে হয়েছে অত্যন্ত ঝঞ্ঝাবিুব্ধ কঠিন ক্রান্তিকাল। এই কঠিন ক্রান্তিকাল পার করে সরকার হয়তো ভেবেছিল, এবার নব উদ্যমে নবযাত্রার পথ কিছুটা কুসুমাস্তীর্ণই হবে। কিন্তু সে গুড়ে যে বালি ছিটিয়ে রাখা হয়েছে আগে থেকেই! ম্যাডাম খালেদা জিয়া এতদিন ধরে যে সকল কণ্টকগুচ্ছ সযত্নে জোগাড় করে রেখেছেন, এখন তিনি মহাউদ্যমে সেইসব কন্টকগুচ্ছকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে (খালেদা জিয়ার পছন্দ মতো আলোচনার ফল না হলে) ফেরার পথে স্বহস্তে এক এক করে বিছিয়ে দেবেন। অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন পরিকল্পনা। কোন কুসুমাস্তীর্ণ পথকে এক বছরের মধ্যে কণ্টকাকীর্ণ করে ভরে দেয়ার মতো বুদ্ধি ও মেধা ক'জনের থাকে? বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে দেশবাসী প্রত্যাশা করে_ তিনি যেন প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনীতি ত্যাগ করে গঠনমূলক চিন্তাধারার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে দেশের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন। তাতে তাঁর ভাবমূর্তি অনেকটা উজ্জ্বল হবে। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং সহমর্মিতা যুগে যুগে মানুষকে, তথা নেতানেত্রীদের মহান করে তোলে। খালেদা জিয়ার স্বামীও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার এবং বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত। তাঁর সহধর্মিনী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরে শক্তি এবং যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি ও সরকার গঠন করে তিনি যে মন-মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসে চিরদিন নিকষ কালো অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে। একদিন এই কৃতকার্যের জন্য পরবতর্ী প্রজন্মের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতেই হবে। জনতার আদালত সব সময় চুলচেরা বিচার করে। এ দেশের জনতা যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগে তখন তাদের থামানো যায় না। তার অনেক জলন্ত উদাহরণ রয়েছে। জনতা যখন জাগবে তখন তারা বিচারপতির বিচার করেই ছাড়বে।
এত কষ্টের, এত ত্যাগের, এত রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে পাওয়া এ দেশ তো আমাদের প্রাণের দেশ। এ দেশটাকে সুন্দর ও উন্নতির শীর্ষে পেঁৗছে দিতে আমরা আরও একটু সহিষ্ণু এবং সচেষ্ট হতে পারি না কেন? কেন এক নদী রক্তের মূল্য দিতে আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাই? হিংসা, দ্বেষ, হীনম্মন্যতা ভুলে আমরা প্রিয় দেশমাতৃকাকে অকৃত্রিম ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারছি না কেন? এ দেশের মানুষ তো একাত্তরে সবকিছু ভুলে গিয়ে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। দল, মত, চিন্তাধারা ভিন্ন হোক_ কিন্তু দেশের স্বার্থে সকল চিন্তাধারা এক মেরুতে এসে দাঁড়াবে কবে? যে দিন দেশের স্বার্থে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এক কাতারে এসে আমরা দাঁড়াতে পারব একাত্তরের মতো, সেদিন এ দেশের উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। সেই দিনটির প্রত্যাশায় আমরা বেঁচে থাকতে চাই যুগ যুগ ধরে। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি এবং কাঁটা বিছানোর রাজনীতি পরিহার করে আমরা গঠনমূলক রাজনীতি করে দেশ উন্নয়নের ল্যে সামনের দিকে অগ্রসর হতে চাই। কারও সম্মুখপথে কাঁটা বিছিয়ে, কাঁটার আঘাতে কাউকে রক্তাক্ত করতে চাই না। বলা যায় না হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সে কাঁটা নিজের পায়ে বিঁধে নিজেকেই রক্তাক্ত করে দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.