বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় গত ১৯ নবেম্বর ঘোষিত হয়। এরপর পাঁচ বিচারপতি গত ১৭ ডিসেম্বর সে ঐতিহাসিক রায়ে স্বার করেন। রায়টির পূর্ণ বিবরণ এখানে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো_ বাংলায় রূপান্তর : by এনামুল হক

(পূর্ব প্রকাশের পর) আদালত তখন এই বিলম্বের কোন কারণ দর্শানো হয়েছিল কিনা তা সন্ধান করেছিল এবং বিবেচনা করে দেখেছিল। বিলম্বের ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে গেলে আদালতের কাজ হচ্ছে শুধু এইটুকু দেখা যে ব্যাখ্যাটা সন্তোষজনক কিনা।
বাদীপ যখন বিলম্বের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয় এবং এই বিলম্ব সম্পর্কে বাদী পরে বক্তব্য অলঙ্করণ বা অতিরঞ্জনের সম্ভাবনা থাকে তখন এই সম্ভাবনাটা একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বিলম্বের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা থাকলে আসামিকে কপটভাবে মামলায় জড়ানোর কিম্বা বাদীপরে মামলায় তার বিপন্ন হওয়ার যুক্তিটা প্রত্যাখ্যান করার জন্য যথেষ্ট। বর্তমান মামলায় এফআইআর-এর তথ্যদাতা মাত্র ১৪ জন আসামিকে এফআইআর-এ জড়িয়েছেন এবং তাদের মধ্যে মাত্র বজলুল হুদার বিরুদ্ধে বিশেষ উদ্দেশ্যে সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর কাজের (ৃরণর্র টর্ড) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন এবং আরও তিনজন আসামিকে শনাক্ত করেছেন এবং অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাকি আসামিদের জড়িয়েছেন। আপীলকারী ও অন্যান্য আসামিকে জড়িত করার এবং/অথবা তাদের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশন করার দুরভিসন্ধি যদি তার থাকত তাহলে আসামি প্রতিটি ব্যক্তি যে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন এফআইআর-এর তার সুস্পষ্ট উল্লেখ তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেপথ অবলম্বন করেননি। এ থেকে প্রমাণ হয় যে তথ্যদাতা ঘটনাস্থলে যা দেখেছেন এবং তদন্তকারী সংস্থা মামলার তদন্তকালে আপীলকারী ও অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে তাদের যোগসাজশ সম্পর্কিত যা কিছু তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এই এফআইআর হচ্ছে তার হুবহু প্রতিলিপি।
আরও দেখা যায় যে, ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ অন্যায়ভাবে মতা পরিগ্রহ করেন ও ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট সাময়িক আইন জারি করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভূতাপে কার্যকারিতা দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকার পরিবর্তন সাধনের কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে কিম্বা সরকার পরিবর্তনের ল্যে প্রয়োজনীয় পদেেপর সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত কোন কাজ বা বিষয়ের েেত্র ঐ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত বা অপর কোন কার্যক্রম গ্রহণের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ জারি করেন।
দেখা যাচ্ছে যে, উক্ত অধ্যাদেশ জারির পর একটা এফআইআর জারি করা যেতে পারত কি পারত না সেটা হলো আইনের ব্যাখ্যার বিষয় এবং আরও দেখা যায় যে, উক্ত অধ্যাদেশটি মনস্তাতি্বক প্রভাবও ফেলেছিল।
আরও উল্লেখ করতে হয় যে, লে. কর্নেল শাফায়াত জামিল (রাষ্ট্রপরে ৪৪ নং সাী) তাঁর জবানবন্দীতে বলেছিলেন যে, আপীলকারী ফারুক রহমান ও মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর রশিদ সর্বদাই বঙ্গভবনে অবস্থান করতেন এবং তাদের সহযোগী অফিসাররা রেডিও স্টেশনে অবস্থান করতেন এবং একটি অলিখিত বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে দেশ শাসন করতেন। ঘটনার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মতাসীন সরকারগুলো ১৫ আগস্টের ঘাতকদের নিরাপত্তা দেয়ায় ঐ ঘাতকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিল না।
স্বীকার করে নেয়া গেল যে, তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ও তার বাসভবনে থাকা তার পরিবারের অপর সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। উপরোক্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতি মতাসীন সরকারের সমর্থন থেকে না থাকলে মতাসীন সরকারগুলোর বাধ্যবাধতাপূর্ণ দায়িত্ব ছিল মৃতু্যর কারণ নির্ণয়ে মামলা রুজু করা এবং ঘাতকদের বিচার করা। কিন্তু এই নির্দিষ্ট েেত্র আইনের প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেয়া হয়নি বরং দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ১৯৭৫ জারি করে মতাসীন সরকার আপীলকারীদেরসহ আসামিদের রা করতে চেয়েছিল এবং আরও বলতে হয় যে, তাদের কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করে বৈদেশিক মিশনগুলোতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আরও বলতে হয়, নিহত বা তিগ্রস্তদের প থেকে কেউ দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ঘাতকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে না থাকলে সরকারগুলো এই মামলা রুজু করতে আইন অনুযায়ী বাধ্য ছিল, বিশেষ করে যখন একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে পরিবার পরিজনসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এবং আরও বলতে হয় যে, আপীলকারীরাসহ অপর আসামিরা হত্যার অপরাধই শুধূ করেননি তারা একটি শিশু ও তিন নিরপরাধ মহিলাকে হত্যা করে মানবতার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতারও পরিচয় দিয়েছে। উপরন্তু উক্ত হত্যাপরাধ একটি আমলযোগ্য অপরাধ বিধায় কেউ যদি নিহতদের প থেকে এমন অপরাধের জন্য এফআইআর দায়ের নাও করে থাকে সেেেত্র ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের দায়িত্ব ছিল ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই এমন অপরাধের তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিল করা। বিজ্ঞ এ্যাটর্নি জেনারেল এবং আজমালুল হোসেন তৎকালীন মতাসীন সরকারগুলোর ন্যায়বিচার প্রয়োগ বা বিধানের পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট সময়ে ন্যায় বিচার প্রয়োগের ব্যবস্থাটি সবদিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল সেটার দায়মোচন করা যায় না। ন্যায় বিচার প্রয়োগ ব্যবস্থার এই ব্যর্থতা দেশে সুবিশাল বিপর্যয়কর প্রভাব রেখেছে যার পুনরাবৃত্তি দেশের স্বার্থেই ঘটতে দেয়া উচিত নয়। জনাব হোসেন বলেন, এটা হলো ইতিহাসের অংশ যা মুছে দেয়া যায় না। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত গোটা প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল, যা আমাদের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত এবং এর পুনরাবৃত্তি আর ঘটতে দেয়া চলে না।
উপরোক্ত বক্তব্যগুলোর সারবত্তা আছে, কারণ ন্যায়বিচার আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বদান্যতা, মহানুভবতা, কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব ও করুণা থেকে ন্যায়বিচার আলাদা। ন্যায়বিচার হলো সমাজের স্ট্যাটাসকে বজায় রাখা। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মর্মমূলে রয়েছে নিরপেতার ধারণা। আরও বলা যায়, সরকার মানুষের নয়, আইনের। আইন যখন শেষ হয়ে যায় তখন শুরু হয় স্বৈরাচার। স্বেচ্ছাচারী মতার অতি বৈপরীত হলো আইন। বিভিন্ন ধরনের গুরু অপরাধের মধ্যে হত্যাপরাধ কিম্বা হত্যা করার আদেশ স্বভাবতই বেআইনী ও অনৈতিক এবং সেই কারণে নাৎসীরা কখনই গণহত্যাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেনি এবং বন্দীশিবিরের কয়েদীদের হত্যার আদেশ সর্বদাই গোপন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এমনকি নাৎসীরাও স্বীকার করে যে, আইনের কোন ব্যবস্থার বিচারে এ ধরনের আচরণের যৌক্তিকতা কখনই প্রমাণ করা যায়না।
একটা দেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ল্য হচ্ছে অপরাধকর্মে লিপ্ত এক শ্রেণীর মানুষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আঘাত থেকে দেশের নাগরিকদের রা করা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রাকর্তা হিসাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রয়োগ ও আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত অপরাধীর অপরাধ জনগণের স্বার্থেই যত দ্রুত সম্ভব নির্ণয় করা হয়। কিন্তু দুভার্গ্যবশত দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যা করার পর এই ধারণাটি উপেতি হয়েছে। একটা শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে অপরাধকর্মে জড়িত প্রতিটি অপরাধীর বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ এবং তার বিচার মোটামুটি দ্রুত গতিতে হওয়া উচিত। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে নাগরিকদের জন্য একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সুনিশ্চিত করার ল্যে দ্রুত ও কার্যকর উপায়ে ন্যায়বিচার প্রয়োগ করতে গিয়ে াগরিক ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকারের ভারসাম্য বিধান করা। সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায় বিচারের সুযোগ না থাকলে আইনের শাসন অর্থহীন।
আমার কাছে মনে হয়েছে বিজ্ঞ বিচারকরা এফআইআর দায়েরে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপরে দেয়া ব্যাখ্যা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ দিয়েছেন। তদুপরি এটা লিপিবদ্ধ সা্য প্রমাণের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধানের বিষয় হওয়ায় সংবিধানের ১০৩ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে এেেত্র এই বিভাগের হস্তপে করার সুযোগ অভ্যন্ত সীমিত।
অতএব আমার অভিমত হচ্ছে, বিলম্বের কারণ যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করায় এই বিভাগের হস্তেেপর কোন প্রয়োজন পড়ে না।
তৃতীয় ভিত্তি অর্থাৎ বিদ্রোহের ব্যাপারে আপীলকারীদের বিজ্ঞ কেঁৗসুলিরা অভিন্ন বক্তব্য পেশ করেছেন যে লিপিবদ্ধ সা্যপ্রমাণ থেকে প্রকাশ পায় যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার পরিজনদের হত্যাকাণ্ড এবং মতার পট পরিবর্তন ছিল কিছু সংখ্যক সেনা অফিসারের বিদ্রোহের ফল এবং তাই বিচারকার্যটি ১৯৫২ সালের সেনা আইনের বিধান অনুযায়ী কোর্ট মার্শালে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল এবং তদনুযায়ী ফৌজদারি কার্যবিধি বিধানের অধীনে আপীলকারীদের এই বিচারটি প্রক্রিয়ার বহিভর্ূত এবং এই বক্তব্যের সমর্থনে সেনা আইনের ৩১ (ক), ৫৯ (৩), ৯২(২), ৯৪ ও ৯৫ ধারা, দণ্ডবিধির ৫ ও ১৩৯ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯৪(২) ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।(ক্রমশ)

No comments

Powered by Blogger.