৪০০ কোটি টাকার জমি দখল-বিমানবন্দর স্টেশনের পাশে তৈরি হচ্ছে দুটি বিপণিবিতান, দুই বছর ধরে চলছে যজ্ঞ by আপেল মাহমুদ

রাজধানীর বিমানবন্দর ভিআইপি রেলস্টেশনের পাশে রেলওয়ের প্রায় দুই একর জমি বেদখল হওয়া পাকাপোক্ত হতে চলেছে। সংরক্ষিত জলাধার ভরাট করে প্রথমে এক একরের ওপর বিপণিবিতান তৈরি করে এরই মধ্যে দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
এ কর্মে সাফল্যের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো এক একর জমি দখল করে দখলদারদের আরেকটি বিপণিবিতানের নির্মাণকাজও শেষ পর্যায়ে। প্রায় দুই বছর চোখের সামনে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের এ জমি বেহাত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও রেল কর্তৃপক্ষ লোকদেখানো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করেনি। বার কয়েক তাদের উচ্ছেদ অভিযান দল সেখান থেকে ঘুরে এসেছে। সম্প্রতি জমি উদ্ধারে নিজেরা মামলা না করে বিমানবন্দর থানাকে মামলা করে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর অনুরোধ জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, নিজেরা উচ্ছেদ অভিযান না চালিয়ে পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া রহস্যজনক। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ দখলকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ, স্থানীয় শ্রমিক লীগের নেতা থেকে শুরু করে স্টেশনের কুলি সর্দার এবং একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত।
বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে প্রায় দুই বছর আগে প্রথমে এক একর জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণ করা হয় 'শাহ কবির' মার্কেট। স্থানীয় পীর শাহ কবিরের নামে এর নামকরণ করা হয় যাতে ভবিষ্যতে উচ্ছেদ অভিযান ঠেকানো যায়। মার্কেটটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সেখানে প্রায় ২০০টি দোকান নির্মাণ করে এসব বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দখলদার চক্রটি। প্রায় নিরুপদ্রবে মার্কেটটি তৈরি করে ফেলার পর চক্রটি পাশে আরো এক একর জমিতে মার্কেট নির্মাণ প্রায় শেষ করে এনেছে।
জানা গেছে, চক্রটির মূল হোতা স্থানীয় প্রভাবশালী ও যুবলীগ নেতা মফিজ সরকার। এই দখল ও নির্মাণযজ্ঞ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিপণিবিতান চলছে। রেল থেকে কোনো বরাদ্দ হয়েছে কি না- এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি।'
উল্লেখ্য, তাঁর 'আদালতের নির্দেশের' ব্যাখ্যায় জানা গেছে, রেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বার কয়েক নোটিশ দেয়। তিনি বলেন, 'মার্কেটের দোকানদাররা কোথায় যাবে' এই মিনতি করলে আদালত অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করেন। চক্রটি এই স্থগিতাদেশকে 'কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ' এই প্রচারণা চালিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে।
রেলের ঢাকা বিভাগীয় সম্পত্তি কর্মকর্তার দপ্তর জানায়, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে কাউকে এক ইঞ্চি জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবে রেল শ্রমিক লীগ, স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা পরিচয়ে এবং বিমানবন্দর স্টেশনের কুলি সর্দার পরিচয়ে কেউ কেউ রেলের বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে নিয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চক্রটি এখন বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে এবং তাদের প্রথম প্রজেক্ট শাহ কবির মার্কেটের পশ্চিম পাশে এক একর নিচু জমি ভরাট করে ১৬৫টি পাকা দোকান নির্মাণকাজ শেষ করে এনেছে। এর মধ্যে ৫৫টি দোকান রেল শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান আখন্দ, ৫৫টি দোকান বিমানবন্দর থানা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রোকন মোল্লা এবং ৫৫টি দোকান রেল ভূমিখেকো হিসেবে পরিচিত ফজলুল হক মৃধা এবং খালেক হোসেন নির্মাণ করছেন বলে নির্মাণ শ্রমিকরা জানান। মার্কেটের মালিক কে, প্রশ্ন করলে ফজলু ও খালেকের ম্যানেজার বাদল বলেন, 'এসব দোকান কারা নির্মাণ করছেন তা কারো অজানা নয়।'
রেল শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান আখন্দ এই দখলকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, 'কেউ কেউ আমার নাম ভাঙিয়ে রেলের জমি দখল করছে। বিমানবন্দর রেলস্টেশনেও চক্রটি আমার নামে দোকানপাট নির্মাণ করছে।' তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, 'বিপণিবিতানের কোথাও আমার নাম নেই। রেলের এস্টেট বিভাগ থেকে মামলার জন্য যে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেখানে রোকন মোল্লা ও ফজলুল হক মৃধার নাম রয়েছে।' তিনি দাবি করেন, ফজলু ও খালেকই একটার পর একটা রেলের জমি দখল করছে। রোকন মোল্লা, ফজলুল হক মৃধারাই তাঁর নাম ভাঙাচ্ছে। দখল করা জমিতে গড়ে তোলা দোকানপাট উচ্ছেদ করলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই বলেও তিনি কালের কণ্ঠকে জানান।
তবে ফজলু ও খালেক এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নিয়ম মেনেই' রেলের জমিতে তাঁরা বিপণিবিতান নির্মাণ করছেন। কিন্তু তাঁরা রেলের কোনো বৈধ বরাদ্দপত্র দেখাতে পারেননি।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, মার্কেটের পশ্চিম পাশে বড় সাইনবোর্ডের নিচে রেলের প্রায় এক বিঘা জমি দখল করে ১৫টি দোকান নির্মাণ করেছেন বিমানবন্দর রেলস্টেশনের কুলি সর্দার আমান। তা ছাড়া তিনি স্টেশনের পূর্ব পাশে রেলের জমিতে গরুর খামার এবং মাদক বেচাকেনার আখড়া তৈরি করেছেন বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করে। প্রতিদিন এসব থেকে তিনি প্রায় ৩০ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করছেন। স্থানীয় আশকোনার বাসিন্দা আবু তালেব বলেন, একজন কুলি হয়ে তিনি একাই রেলের প্রায় ৫০ কোটি টাকার জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন।
অভিযোগ সম্পর্কে কুলি আমান বলেন, এস্টেট বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়েই তিনি দোকানপাট নির্মাণ করেছেন। অনুমতিপত্র দেখতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলেন, 'রেলের জমি এমনিতেই পড়ে আছে তাই সেখানে দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছি।' রেলের জমিতে মাদকের আখড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ভাই ৪০ বছর এখানে মাদক বেচাকেনা এবং সেবন চলছে। যে কেউ এখানে এসে মাদক কেনাবেচা এবং সেবন করতে পারে। ইচ্ছা হলে আপনিও আসতে পারেন।'
রেলের এস্টেট বিভাগ সূত্র জানায়, বিমানবন্দর স্টেশনের রেলের জমি দখলের কথা রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে সেই জমি সংরক্ষণ করা হয় না। তবে এস্টেট বিভাগ কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই সব অভিযানকে আইওয়াশ মনে করে। তারা বলে, এস্টেট শাখা থেকে মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালানো হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দখলদারদের সঙ্গে আপস করে দু-একটি স্থাপনায় আঁচড় কেটে তারা ফিরে যায়।
রেলওয়ে এস্টেট বিভাগ এই অভিযান পর্বেও ক্ষান্ত দিয়ে সম্প্রতি বিমানবন্দর থানাকে মামলা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য চিঠি দিয়েছে। গত মাসের ২৯ তারিখে এস্টেট বিভাগের কর্মকর্তা এ বি এম গোলাম মোস্তফা বিমানবন্দর থানাকে চিঠি দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করার অনুরোধ করেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে বিমানবন্দর থানা সূত্রে জানা গেছে। বিমানবন্দর থানার ওসি শামসুদ্দিন সালে আহমেদ চৌধুরী রেলের এস্টেট বিভাগ থেকে চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, 'সম্পত্তি উদ্ধারের দায়িত্ব রেলের এস্টেট বিভাগের। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বিমানবন্দর থানাকে মামলা করে সম্পত্তি উদ্ধারের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো থানায় মামলা করা হয়নি।' রেলের জমি অবৈধভাবে দখল হয়েছে কি না সে ব্যাপারে বর্তমানে তদন্ত চলছে বলে তিনি জানান।
চিঠিতে ফজলুল হক মৃধা এবং রোকন মোল্লাকে অভিযুক্ত করা হলেও রেল শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান আখন্দ এবং কুলি সর্দার আমানের নাম দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে রেলের এস্টেট বিভাগের একটি সূত্র জানায়, হাবিবুর রহমান একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় কৌশলে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কুলি সর্দার আমান নিয়মিত এস্টেট বিভাগের কিছু কর্মকর্তাকে উৎকোচ দেন বলে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
রেলের এস্টেট বিভাগ জানায়, এর আগে রেলের জমি দখলের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের শাস্তিস্বরূপ আর্থিক জরিমানা করা হয়। কিন্তু আবার তাঁরা অবৈধ দখলে জড়িয়ে পড়েন। বিভাগীয় সম্পত্তি কর্মকর্তা আহমেদুল হক বলেন, 'অচিরেই তাঁদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে উচ্ছেদ করার জন্য নিয়মিত মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। এ দখলের বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।'
রেলের দখলকৃত জমির ওপর গড়ে ওঠা শাহ কবির মার্কেট বর্তমানে জমজমাট। সেখানে একটি ছোট দোকান পাঁচ লাখ এবং বড় দোকান ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুদি দোকানদার আবদুল আজিজ জানান, মার্কেটের মালিক দাবিদার এবং ঢাকা মহানগর যুবলীগের সদস্য মফিজ সরকারকে পাঁচ লাখ টাকা সালামি এবং মাসিক ছয় হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন। কারো কারো কাছ থেকে সাত-আট লাখ টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়েছে বলেও নাম প্রকাশে একজন দোকানদার জানান। দোকানদাররা বলেন, দখলদারদের কেউ কেউ বলেছেন তাঁদের কাছে রেলের জমিতে মার্কেট বানানোর 'জরিমানা লাইসেন্স' রয়েছে। এ জরিমানা লাইসেন্স সম্পর্কে ঢাকা বিভাগীয় এস্টেট কর্মকর্তা আহমেদুল হক বলেন, 'রেলের জমি অবৈধভাবে দখল করার জন্য দখলদারদের অপরাধী সাব্যস্ত করে আর্থিকভাবে শাস্তি দেওয়া হয় এ শর্তে যে ভবিষ্যতে তারা রেলের কোনো জমি অবৈধভাবে দখল করবে না। অথচ সেই শাস্তির ডকুমেন্টসকে তারা জরিমানা লাইসেন্স বানিয়ে দখলকৃত জমির বরাদ্দপ্রাপ্ত হিসেবে প্রচার করছে।'
স্থানীয়রা জানায়, অবৈধ দখলের ফলে রেলের শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়াই কেবল হচ্ছে না, এতে একই সঙ্গে পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। সংরক্ষিত জলাধার ভরাট করে সেখানে দোকান নির্মাণ করা হলে দেশের একমাত্র ভিআইপি রেলস্টেশনটি হুমকির মুখে পড়বে। একই সঙ্গে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের মাস্টার হরি গোপাল সেনও এ আশঙ্কার কথা স্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাওয়ার ঘটনা তাঁর জানা ছিল না। ঘটনা সত্যি হলে সরকারি সম্পত্তি দখলের সঙ্গে জড়িতদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, 'তারা যত বড় প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের রেলের জমি অবৈধভাবে ভোগ করতে দেওয়া হবে না। অচিরেই বিভাগীয় এস্টেট অফিসারকে ডেকে আমি সুনির্দিষ্ট মামলা করে রেলের জমি উদ্ধারের নির্দেশ দেব।'
সর্বশেষ : রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরদিনই তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রেলের মূল্যবান সম্পত্তি থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু কর্মকর্তারা একটু খোঁজ-খবর নিয়েই তাঁদের কর্মকাণ্ড শেষ করে দেন বলে রেল ভবনের একটি সূত্র জানায়।

No comments

Powered by Blogger.