রফিকুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড-র‌্যাবের ধারণা নেপথ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ by এস এম আজাদ

র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণের পর রাজধানীর বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদারকে হত্যার ঘটনা তিন রহস্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি। আপাতত হত্যার আলামত ধরে তদন্ত শুরু করেছে র‌্যাব ও পুলিশ।
র‌্যাবের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ ওঠার পর স্থানীয় র‌্যাব ব্যাটালিয়ন এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিট ঘটনাটির তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে। গতকাল র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে রফিকুল খুন হতে পারেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিরোধকেও গুরুত্ব দিয়ে র‌্যাব তদন্ত করছে।' জিয়াউল আহসান আরো বলেন, 'আগেই বলা হয়েছে র‌্যাবের কোনো অভিযানে রফিকুল আটক হননি। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারা, কিভাবে এটি ঘটাল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'
রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার মহানগর মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও বঙ্গবাজার মার্কেট নামে চারটি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি ছিলেন রফিকুল ইসলাম মজুমদার। বঙ্গবাজার এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ বছর ধরে ওই এলাকায় ব্যবসা করছিলেন রফিক। ছিলেন ফিনিক্স রোডের মহানগর কমপ্লেক্স মার্কেটের একজন পরিচালক। ১৯৯৬ সালে ওয়াকফ স্টেটের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে করা হয় ঢাকা সুপার মার্কেট ও বাংলাদেশ সুপার মার্কেট। ওই সময় ঢাকা সুপার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন হাজি ওয়াজিউল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ সুপার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ করতেন বাবুল মিয়া নামের আরেকজন। মার্কেটের নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ ছিল বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের। ১৯৯৭ সালের দিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত গ্রুপ রেলওয়ের কাছ থেকে মার্কেট দুটি ইজারা নিয়ে দখল করে।
জানা যায়, এ মার্কেটের জায়গা নিয়ে রেলওয়ে ও ওয়াকফ স্টেটের মধ্যে মামলা আছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের শেষ দিকে ২০০৮ সালে দুটি মার্কেটকে এক করে মহানগর বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের ব্যানারে মহানগর কমপ্লেক্স নাম দেওয়া হয়। ওই সময় আবদুর রহমান ও রফিকুল ইসলাম মজুমদার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেন। রহমান বর্তমানে ওই মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি। ১৬ জন পরিচালক ওই মার্কেটের মালিকানা পান। এর ভেতর থেকে বাদ দেওয়া হয় আগের নিয়ন্ত্রক ওয়াজিউল্লাহকে। বর্তমান সরকারের আমলে দুই এমপি, একজন পরিবহন নেতা বঙ্গবাজার ও গুলিস্তানের মার্কেটগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে আবদুর রহমান পেয়েছেন দোকানের মালিকানা।
সূত্র জানায়, তিনটি মার্কেটে ছয় শতাধিক দোকান থেকে মাসে ৪০ লাখ টাকা ভাড়া তোলা হয়। আর ওই মার্কেটে রহমান, রফিকুলসহ কয়েকজনের শতাধিক দোকান আছে। এসব দোকানের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারদলীয় একটি পক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। ২০১০ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হওয়ার ছয় দিন আগে এ নিয়ে কথা কাটাকাটির জের ধরে তিনি বলেছিলেন, 'সরকার বদল হলে এ ব্যাপারে দেখা হবে।' একাধিক সূত্রের দাবি, আলম নিখোঁজ হওয়ার পর ওয়াজিউল্লাহর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন রহমান ও রফিকুলসহ অন্য নিয়ন্ত্রকরা। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই হাজি ওয়াজিউল্লাহও নিখোঁজ হন। তাঁর স্বজনের আশঙ্কা, মার্কেট নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে। ওয়াজিউল্লাহর স্ত্রী সালেহা বেগমের দায়ের করা অপহরণ মামলায় আসামি করা হয় মার্কেটের সাবেক সভাপতি জালাল আহম্মদ, ব্যবসায়ী মীর আল-মামুন, আবদুর রহমান হুজুর, গোলাম মাওলা, রফিকুল ইসলাম মজুমদার, কালা রফিক, কিবরিয়া ও জাহাঙ্গীর আলমকে। মামলাটি তদন্তের পর গোয়েন্দা পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ঢাকা সুপার মার্কেটের মালিকানা ও দখল-সংক্রান্ত বিষয়ে কথিত ভিকটিম হাজি ওয়াজিউল্লাহ ও বিবাদী পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মনোমালিন্য ও বিরোধ চলে আসছে। এর জের ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে। এই মামলার বাদী সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আসামিদের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে এজাহারে উল্লেখ করেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে এই মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী মেলেনি।' তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবদুল হান্নান বলেন, ব্যবসায়ী ওয়াজিউল্লাহকে অপহরণের যে অভিযোগ করা হয়েছিল, এ ব্যাপারে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। মামলার আসামি গোলাম মাওলা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মার্কেটে দ্বন্দ্ব আছে। তাই মামলা হয়েছে। যাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তাদের আসামি করা হয়েছে। আবার যাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নেই তাদেরও আসামি করা হয়েছে।'
অভিযোগ পাওয়া গেছে, সম্প্রতি আবদুর রহমানের সঙ্গে রফিকুলের মার্কেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক সপ্তাহ আগে এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটিও হয়। এ কারণে চৌধুরী আলম ও ওয়াজিউল্লাহর মতোই রফিকুলের পরিণতি হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করছেন কেউ কেউ। গতকাল মহানগর কমপ্লেক্সে গিয়ে এবং মোবাইল ফোনে আবদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আদর্শ মার্কেটের সভাপতি শাহ আলম বলেন, 'মার্কেট নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেই রফিকুলকে হত্যা করা হতে পারে বলে শুনছি। এর আগে দুজন গুম হয়েছে। এ ব্যাপারে তদন্ত হওয়া দরকার।'
গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটের সভাপতি নূর ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হত্যাকাণ্ডের পেছনে জানি না কী কারণ আছে। তবে লোকটা ভালো ছিল। তাঁর হত্যার বিচার চাইছি আমরা।'
রহস্যঘেরা সফর : শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া এবং সেখান থেকে অপহরণ হওয়ার ঘটনায়ও রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীতে রফিকুলের অবস্থান এবং বিরোধের জের হিসেবে ঝিনাইদহে তাঁকে হত্যা করা নাও হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফুলবাড়িয়ায় রেলওয়ে হাসপাতালের কর্মচারী সোহরাব মিয়ার সঙ্গে এক দশক আগে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে রফিকুলের। এ সম্পর্কের সূত্র ধরে সোহরাবের ছেলের সঙ্গে রফিকুলের চাচাতো ভাই শহীদুলের মেয়ের বিয়ে হয়। ওই সোহরাবই রফিকুলের দ্বিতীয় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা ঝরার ফুফা। ঝিনাইদহে সোহরাবের বাড়িতে যাওয়ার সুবাদে ঝরার সঙ্গে রফিকুলের পরিচয় হয়। ওই সময় রফিকুলের প্রথম স্ত্রী রুবিনা ইসলামের সংসারে চার সন্তান ছিল। প্রথম স্ত্রী ব্যাপারটি মেনে নিতে না পারায় তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। জানা গেছে, রফিকুলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে ঝরার আরো দুইবার বিয়ে হয়েছিল।
আরো জানা গেছে, ঝরার আসল বাড়ি কুষ্টিয়ার বিশনদী এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবা শহীদুল ইসলাম থাকেন। পাঁচ বছর আগে ঝরাকে বিয়ে করার ছয় মাস পরই ঝিনাইদহের শৈলকুপার আনন্দনগর গ্রামে সাড়ে ছয় লাখ টাকার জমি কেনেন রফিকুল ইসলাম। ঝরার নামে কেনা ওই আট শতাংশ জমিতে বাড়িও নির্মাণ করেন তিনি। ওই বাড়িতে ঝরার মা লিপি খাতুন থাকেন। রফিকুল মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে থাকতেন। জানা গেছে, গত ঈদুল আজহার পর ১১ ডিসেম্বর স্ত্রী ঝরাকে নিয়ে ওই বাড়িতে যান রফিকুল। এরপর গত শুক্রবার যান একাই।
এদিকে এবার যাওয়ার সময় রফিকুলের কাছে একটি ব্রিফকেসে ১৮ লাখ টাকা ছিল বলে দাবি করেছিলেন রফিকুলের ভায়রা সাইদুজ্জামান সাইদ। তবে তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্রিফকেসটি খোয়া যায়নি। ব্রিফকেসের চাবি ছিল রফিকুলের কাছে। এটি তাঁর ভাইকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে কী আছে তাঁরা জানেন না। এ ব্যাপারে রফিকুলের অন্য স্বজনরাও মুখ খোলেনি।
এদিকে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঝরা তাঁর আগের পক্ষের চার ছেলেমেয়েকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলেও সন্তানরা তাঁকে অনেকটা মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে ছিল পারিবারিক দূরত্ব। তাই সন্তানদের দেখাশোনার জন্য ছোট ভাই মফিজুর রহমানকে বাসায় এনে রেখেছিলেন রফিকুল ইসলাম। তবে আয়েশা সিদ্দিকা ঝরা দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল। রফিকুলের বড় ছেলে রাকিবুল হাসান রকি মজুমদার বলে, 'আমরা বুঝতে পারছি না কারা, কেন এটি করেছে।'
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার : জানা গেছে, ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর রফিকুল ইসলাম দলীয় কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। বঙ্গবাজার এলাকা থেকে প্রতিটি কর্মসূচিতে তিনি কর্মীও সরবরাহ করতেন। তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে প্রচারণাও শুরু করেন। রফিকুলের ছোট ভাই মফিজুর রহমান বলেন, 'ভাইয়া দল করার কারণে তাঁর কিছু শত্রু ছিল। ব্যবসায় বাধা দিত। মিথ্যা মামলাও দিছে।' ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক জাহিদ হোসেন নওয়াব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জনপ্রিয়তার কারণে সরকারি দলের রোষানলে পড়তে পারেন রফিকুল। র‌্যাব পরিচয়ে কারা নিয়ে গেল, কেন নিয়ে গেল- সবই তদন্ত হওয়া দরকার।'
খুনিদের জুতা : কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার ওসি আলী নওয়াজ কালের কণ্ঠকে জানান, শনিবার রাতে উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের আদাবাড়িয়া গ্রামের মাঠের পাশ থেকে রফিকুল ইসলামের লাশ উদ্ধারের সময় শরীরের কাপড়চোপড় ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে পরে তল্লাশি চালিয়ে ২০ গজ দূরে এক জোড়া জুতা পাওয়া গেছে। ওই জুতা জোড়া রফিকুলের নয়। কারণ রফিকুল বাড়িতে লুঙ্গি পরা অবস্থায় ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, খুনিরা ওই জুতা ফেলে গেছে। হাতকড়া ও পোশাকের সঙ্গে ওই আলামতগুলো শৈলকুপা থানায় পাঠানো হবে বলেও জানান ওসি।
মামলা হয়নি : রফিকুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। লাশ উদ্ধারের পর ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এর ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। শৈলকুপা থানার ওসি আবদুল বারি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিবার অভিযোগ দিলেই মামলা নেওয়া হবে। তারা আমাদের বলেছে, লাশ দাফন করে দলীয় সিদ্ধান্তের পর মামলা দিতে আসবে।'
বঙ্গবাজারে লাশ, উত্তেজনা : গতকাল সকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রথম জানাজা শেষে রফিকুলের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবাজারের ফুলবাড়িয়ার ফিনিক্স রোডে। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে দ্বিতীয় জানাজা শেষে লাশ গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে নিয়ে দাফন করা হয়। বঙ্গবাজারে রফিকুলের লাশ দেখতে সহস্রাধিক ব্যবসায়ী ও শ্রমিক ভিড় করে। নিহত রফিকুলকে দেখে তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় কয়েকটি বাসও ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা। তারা রফিকুলের হত্যার বিচার দাবি করে স্লোগান দেয়। পরে তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়ে গতকাল বঙ্গবাজারের সব মার্কেট শোক পালন উপলক্ষে সারা দিন বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা।

No comments

Powered by Blogger.