৬০ লাখ আমেরিকানের বাঁচার অবলম্বন ফুড স্ট্যাম্প কার্ড by এনামুল হক

বিত্তের দেশ, সম্পদের দেশ আমেরিকা। সমৃদ্ধি সেখানে উপচিয়ে পড়ে। সম্পদের জোরে, শক্তির জোরে আমেরিকা আজ বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। ধনীদের ধনী আমেরিকা দরিদ্র দুনিয়ার মানুষের চোখে স্বপ্নের দেশ।
ভাগ্যের সন্ধানে তাবত বিশ্বের মানুষ সেই স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানে না, লাখ লাখ আমেরিকানদের আয় বলে কিছু নেই। তারা স্রেফ বেকার। তারা নগদ অর্থ সাহায্য যেমন পায় না, তেমনি পায় না কোন কল্যাণ ভাতা, বেকার বীমার অর্থ, অবসরভাতা, সনত্মান সহায়তা ভাতা কিংবা অৰমতা ভাতা। তাদের অনাহারেই ধীরে ধীরে মৃতু্যর কোলে ঢরে পড়ার কথা। তথাপি তারা বেঁচে আছে শুধু একটি ব্যবস্থার বদৌলতে। আর সেটা হলো ফুড স্ট্যাম্প কার্ড। কয়েক শ' ডলার মূল্যের এই ফুড স্ট্যাম্প কার্ড দিয়ে শুধু খাদ্যই কেনা যায়_ অন্য আর কিছু নয়। ফুড স্ট্যাম্প কার্ডের ওপর নির্ভরশীল আমেরিকানদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এই সংখ্যাটি ইতোমধ্যে রেকর্ড উচ্চতায় পেঁৗছেছে এবং দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতি ৫০ জন আমেরিকানের মধ্যে একজন এমন পরিবারে বাস করে যাদের আয় বলতে ফুড স্ট্যাম্প কার্ড ছাড়া আর কিছুই নেই।
এবারের মন্দার ছোবলে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সব আমেরিকান পরিবার কমবেশি আক্রানত্ম হয়েছে। তবে ফুড স্ট্যাম্প কার্ডের ওপর নির্ভরশীল আমেরিকানদের সংখ্যা মন্দা আগে থেকেই বাড়ছিল। গত দু'বছরে এদের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা জালের মধ্যে নিয়ে আসতে ফুড স্ট্যাম্পের ভূমিকা এতই বাড়ছে যে এখন প্রতি চারজন শিশুর একজনসহ প্রতি আটজন আমেরিকানের একজন এই স্ট্যাম্প কার্ড পাচ্ছে।
ফুড স্ট্যাম্প কার্ডের আনুষ্ঠানিক নাম সাপিস্নমেন্টাল নিউট্রিশন এ্যাসিস্টেন্স প্রোগ্রাম। এই কর্মসূচীর সুবিধাপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু থেকে ভবঘুরে বেকার পর্যনত্ম সব ধরনের নরনারীই আছে। এমন মানুষও আছে যাদের কারোর কারোর আয় আগে ছিল ছয় অঙ্কের। মন্দা ও আবাসন ব্যবসায় ধসের কারণে তারা সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে। শুধু ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা এখন এত দ্রম্নত বাড়ছে যে তার মধ্য দিয়ে মার্কিন জনগোষ্ঠীর একাংশের ক্রমবর্ধমান দুঃখ-দুর্দশার চিত্রই প্রতিফলিত হয়। এই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা স্ফীতির প্রেৰাপটে ফুট স্ট্যাম্প কর্মসূচীও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। চলতি বছর এই কর্মসূচীর ব্যয় ৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি দাঁড়াবে।
ফুড স্ট্যাম্পের সুবিধাপ্রাপ্তদের এই স্ট্যাম্প পাওয়ার জন্য আগে ঘোষণা দিতে হয় যে তাদের অন্য আর কোন আয় নেই। রাজ্য কর্তৃপৰ এসব ঘোষণা যাচাই করে দেখে। ফেডারেল সরকার করে অডিট। স্ট্যাম্প প্রাপ্তরা ওই স্ট্যাম্প দিয়ে শুধু খাদ্যই কিনতে পারে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রে ফুড স্ট্যাম্পপ্রাপ্ত লোক যত রয়েছে তার ৬০ শতাংশ রয়েছে ৩১টি অঙ্গরাজ্যে। এসব রাজ্যের এই শ্রেণীর মানুষের আয় সংক্রানত্ম তথ্য সংগ্রহ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। তারপর সেসব তথ্য বিশেস্নষণ করে দেখেছে, শতকরা ১৮ জন তাদের অতি সাম্প্রতিক মাসিক বিবরণীতে নগদ উপার্জনকে শূন্যের কোটায় দেখিয়েছে। সেদিক থেকে বিচার করলে গোটা দেশে এমন লোকের সংখ্যা হবে ৬০ লাখ যার মধ্যে ১২ লাখ শিশু।
আমেরিকায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপন্ন মানুষ বরাবরই ছিল। ফি বছর এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অর্থনৈতিক মন্দা ও অন্যান্য সঙ্কট তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির হারকে অতিদ্রম্নত বাড়িয়ে তুলেছে। এই শ্রেণীর মানুষ কেউবা বিৰিপ্তভাবে টুকটাক কাজ করে দিন কাটিয়ে দেয়, কেউ নিকটাত্মীয়দের ঘাড়ে গিয়ে চাপে, কেউ ভর্তুকি ভাড়ায় এপার্টমেন্টের মতো নগদ অর্থ বহির্ভূত সাহায্য পায়, কেউ বেকার বীমার অর্থে চলে, কেউ পায় আর্থিক সাহায্য। আবার অন্যরা মাসের পর মাস শুধু খাদ্য স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করে থাকছে। এটা তাদের নিদারম্নণ দুর্বিষহ অবস্থা থেকে রৰা করছে। মার্কিন শিশু ও পরিবার দফতরের উপসচিব ভন উইনস্টিড বলেছেন, কর্মসূচী যে উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে তা হলো অতি দুস্থ লোকজনকে এক অতি কঠিন সময় অতিক্রম করতে সাহায্য করা। এই কর্মসূচী না থাকলে তারা আরও নাজুক অবস্থায় পড়তো।
এটা সত্য যে, নগদ অর্থনির্ভর কল্যাণ কর্মসূচী 'টেম্পোরারি এসিস্টেন্স ফর নিডি ফ্যামিলিজ' মন্দার সময় মোটেই তেমন সম্প্রসারিত হয়নি। বরং বেকার বীমার মতো একটা ভিন্ন কর্মসূচীর দ্রম্নত প্রসার ঘটেছে। তারপরও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বেকার ওই কর্মসূচীর আওতার বাইরে থেকে গেছে। শেষ অবলম্বন হিসেবে এসেছে ফুড স্ট্যাম্পের মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা যার সুযোগ লাভ করাও খুব সহজ। চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় গরিব লোকজনের নগদ অর্থ সাহায্য পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠায় সাম্প্রতিককালে এই কর্মসূচীভুক্ত লোকের সংখ্যাও দ্রম্নত বেড়েছে।
অন্যদিকে এর সমালোচকরা বলেন, খাদ্য স্ট্যাম্প কার্ড বিপন্ন জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান নয়। লোকের দরকার উপার্জনগত সহায়তা। ফুড স্ট্যাম্প ওই সহায়তা দেয় না বিধায় সমস্যার সমাধানও দিতে পারে না। জর্জিয়ার রিপালিকান দলীয় প্রতিনিধিসভা সদস্য জন লিন্ডার বলেন, 'এটা এক ধরনের পাগলামি। সরকারের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে স্বচ্ছন্দে চলতে পারে এমন মানুষের পুরো একটি শ্রেণী তৈরি করার ঝুঁকির মুখে আমরা রয়েছি। তিনি বলেন, আপনারা অর্থনীতির উন্নতি করছেন না। তার বদলে লোককে পয়সা দিচ্ছেন আর তারা বসে বসে খাচ্ছে। তা না করে আপনারা করের হার কমিয়ে অর্থনীতির উন্নতি করম্নন। তাহলে ছোট ব্যবসায় গড়ে উঠবে এবং সেগুলো অধিক থেকে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।'
অনুৎপাদনশীল ব্যয় ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির এমন সমালোচনা সত্ত্বেও এই কর্মসূচী মার্কিন সমাজের বিপন্ন জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বিধানে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করছে বলে বিশেস্নষকরা মনে করেন। সেটা সম্ভব হচ্ছে কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে একটি হলো কর্মসূচীর সুবিধাপ্রাপ্তরা ফুট স্ট্যাম্প দিয়ে শুধু খাদ্যই কিনতে পারে_ অন্য কিছু নয়। সে কারণে এৰেত্রে অপব্যবহারের সুযোগ বা সন্দেহ অনেক কম যা আছে নগদ অর্থ সাহায্যের ৰেত্রে।
এই কর্মসূচী এক অনিশ্চিত নিরাপত্তাহীন জীবনধারাকে তুলে ধরে বটে। তথাপি এমন জীবনধারায় মানুষের ভিড় দ্রম্নত বাড়ছে। এই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা গত দু'বছরে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে নেভাদায়। ফোরিডা ও নিউইয়র্কে বেড়েছে দ্বিগুণ। আর মিনেসোটা ও ইউটাহ'য় প্রায় ৯০ শতাংশ। মিশিগানের ওয়েন কাউন্টিতে প্রতি ২৫ জন অধিবাসীর একজন শুধু ফুড স্ট্যাম্পের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ওয়াশিংটনের ইয়াকিমা কাউন্টিতে সেই সংখ্যাটা প্রতি ১৭ জনে একজন। আবার অন্যদিকে ফোরিডার লি কাউন্টির প্রায় ১৫ হাজার লোক জানিয়েছে, তাদের ফুড স্ট্যাম্পের আয় ছাড়া অন্য আর কোন আয় নেই।
ফুড স্ট্যাম্পের যাবতীয় খরচ জোগায় ফেডারেল সরকার। আর রাজ্য সরকারগুলো কেবল এর আনুষঙ্গিক খরচ জোগায়। এর পেছনে রাজ্যগুলোর গাঁটের পয়সা খুব একটা খরচ হয় না বলে তারা যতটা সম্ভব সর্বাধিক সংখ্যক লোককে এই তালিকাভুক্তির চেষ্টা করে। তবে ফেডারেল হোক আর রাজ্য হোক সরকার মাত্রই ফুড স্ট্যাম্পের আবেদনকারীদের স্ট্যাম্প ইসু্য করে খালাস। এই শ্রেণীর লোকেরা নগদ উপার্জন ছাড়া কতদিন চলবে কিংবা তাদের অন্য আর কোন সম্পদ আছে কি না তা দেখতে যাওয়া হয় না। সুতরাং বলা যায়, ফুড স্ট্যাম্প প্রকৃত সমস্যার সমাধান করে না_ সমস্যাকে এড়িয়ে যায়।
আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে, ফুড স্ট্যাম্প প্রাপ্তদের মধ্যে এমন অনেক ভাগ্যবিড়ম্বিত নরনারী আছেন যারা এক সময় অতি সচ্ছল জীবনযাপন করেছেন। এমনও মানুষ আছে যাদের কারোর কারোর আয় আগে ছিল ছয় অঙ্কের। বাড়ি ছিল, বাড়িতে সুইমিং পুল ছিল, বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ ছিল। কিন্তু আবাসন ব্যবসায় ধস নামায়, সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে। এমনই একজনের নাম ইসাবেল বামর্ুদেজ। দুই কন্যা ও নিজের অল্প সংস্থানের জন্য মাত্র কয়েক শ' ডলারের ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করে চলেন। ৪২ বছর বয়স্ক মিজ বার্মুদেজ বলেন, 'এই কার্ড পেয়ে প্রতিটি মাস আমি অনত্মত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি। আমি জানি আমার সনত্মানদের অনাহারে থাকতে হবে না।' বার্মুদেজের জীবনটা গল্পের মতো মনে হয়। ম্যানহাটানের একটা রিয়েল এস্টেট ফার্মে কেরানির চাকরি করতেন। ২০০২ সালে তিনি সহজশর্তে প্রায় সোয়া লাখ ডলারের একটি বাড়ি মর্টগেজ লাভ করেন। তখন চাকরি ঋণের মতো সহজলভ্য ছিল। তিনি কেরানির চাকরি ছেড়ে সেলে চলে আসেন। অচিরেই তার আয় দাঁড়াল বছরে প্রায় পৌনে দু'লাখ ডলার। কিন্তু তার পরই স্বর্গ থেকে পতন। আবাসন ব্যবসায় ধস নামল। মন্দা আঘাত হানল। বার্মুদেজ চাকরি হারালেন, বাড়ি হারালেন, সর্বস্বানত্ম হলেন। সঞ্চয়ের টাকাটাও এক পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। তিনি পথে বসলেন। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন বাড়িতে মেয়ে দুটির জন্য পর্যাপ্ত খাবার নেই। ওইদিনই তিনি ফর্ম পূরণ করে ফুড স্ট্যাম্পের ব্যবস্থা করলেন। তার একক আয় এখন ৩২০ ডলারের ফুড স্ট্যাম্প। মা সরকারী ভাতার ওপর চলতেন। কিন্তু গর্বিতা কর্মজীবী মহিলা হিসেবে বার্মুদেজ কখনই তা চাননি। নিয়তির কি পরিহাস। যার আয় ছিল বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার আজ তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে ফুড স্ট্যাম্প কার্ডের ওপর।
রেক্স ব্রিটন (২২) আগে পার্কিং লটগুলো পেইন্ট করে রোজগার করত। এখন বেকার। বেকারত্বের হার যেখানে প্রায় ১৪ শতাংশ এবং চাকরি সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে সেখানে রেক্স ব্রিটনের মতো বেকার যুবকদের বেঁচে থাকার জন্য ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। মাসে দু শ' ডলার ফুড স্ট্যাম্প পায় সে। থাকে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে তার রেন্ট সার্বসিডি পাওয়া বাড়িতে। ফুড স্ট্যাম্প না পেলে তাকে না খেয়ে মরতে হতো।
এককালের পেশাদার খেলোয়াড় উইলিয়াম ট্রাপানি (৫৩)। পরবতর্ীকালে কোকেন বিক্রির অপরাধে নয় বছর জেল খেটেছেন। এখন একটা রেসকিউ মিশনে রাত কাটান, সামান্য পয়সার বিনিময়ে বাইসাইকেল মেরামত করেন এবং ২শ' ডলারের ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করে দিন গুজরান করেন। ট্রাপানি বলেন, প্রতিদিন কাজের সন্ধান করি। কিন্তু কোথাও কাজ নেই।
ওয়ানদা ডেবনাম (৫৩) একদা ১৮ হুইলার চালাতেন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসার স্বপ্ন দেখতেন। এ বছর বেকার হয়ে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন বটে, তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য নির্ভর করেন তার ফুড স্ট্যাম্পের ওপর। এমনিভাবে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর চলেন দুই ভাইবোন কেভিন জিরম্নলো ও ডায়ান মার্কাল। এমনি ইসাবেল, ব্রিটন, ট্রাপানি, ওয়ানদা, কেভিন ও ডায়ান লাখে লাখে ছড়িয়ে আছে মার্কিন সমাজে। ক্রমাগত বেড়েই চলেছে তাদের সংখ্যা। ফুড স্ট্যাম্পই এ মুহূর্তে তাদের একামাত্র ভরসা। কিন্তু সেই ভরসা কতদিন চলবে কে জানে!
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইন

No comments

Powered by Blogger.