কেউ আমাকে দেখতে আসে না...

'পত্রিকায় লিখে কি লাভ? আমাকে তো কেউ আর দেখতে আসে না!' কথাগুলো দুঃখের, বেদনার, হতাশার এবং একই সঙ্গে অভিমানেরও। দীর্ঘশ্বাস এবং হতাশার মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে কথাগুলো।
কথাগুলো বলেছেন দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ। সোমবার জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক রিপোর্টে তাঁর অনেক দুঃখ-বেদনা ও হতাশার কথার মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে ঐ কথাগুলো। একানত্ম সাৰাতকারে তিনি অকপটে প্রকাশ করেছেন তাঁর এই অভিব্যক্তি।
বয়স হয়েছে তাঁর। এই বয়সে নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় তিনি আক্রানত্ম। চলাফেরা করতে পারেন না, ঘর থেকে বের হতে পারেন না। একেবারে শয্যাশায়ী। বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা একটা দুর্ভোগের ব্যাপার। সেই দুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থাভাব। এই বয়সে চিকিৎসা, ওষুধ এ সবের যে প্রয়োজন কতখানি সেটা বোঝা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সেই আর্থিক সচ্ছলতাও তাঁর নেই। তাই বোঝাই যায়, এ বয়সে সত্যিকার চিকিৎসা বলতে যা বোঝায় সেটা তাঁর হয় না। এ সমস্যাগুলো তাঁকে হতাশ করলেও, আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য চিকিৎসা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে শারীরিক কষ্ট ভোগ করলেও তাঁর মতো একজন মানুষের আরেকটি বড় দুঃখ_তিনি এখন বন্ধুহীন, সঙ্গী, সাথীহীন ঘরে গৃহকোণে শয্যাশায়ী। কেউ তাঁর খোঁজ নেয় না, কাছে যায় না। দূরের এক মানুষ, বিস্মৃত এক মানুষ হিসেবে দিন কাটছে তাঁর। তাঁর মতো একজন মানুষের পৰে এ দুঃখটাও সামান্য কিছু হতে পারে না, সেটা সুস্পষ্ট।
মানুষ ধীরে ধীরে বয়সজনিত কারণে এক পর্যায়ে বাইরের পরিবেশ ছেড়ে ঘরের পরিবেশে চলে যেতে বাধ্য হয়। যে সময় সর্বাধিক মনে পড়ে সঙ্গী-সাথী, সতীর্থদের কথা, সমাজের কথা। এ সময় শরীরের প্রয়োজন সুচিকিৎসা, মনের প্রয়োজন সবার সহানুভূতি, সঙ্গ, প্রয়োজন মনোযোগ। যে কোন মানুষ বার্ধক্যে এগুলো থেকে বঞ্চিত হলে তার দুঃখের সীমা থাকে না। কষ্ট এবং অভিমানেরও সীমা থাকে না। আর অলি আহাদের মতো একজন রাজনীতিবিদ যদি ঐ রকম অবস্থায় পড়েন তাহলে তাঁর মতো মানুষের মনের অবস্থা কী রকম হয়, তাঁর হতাশা কোন্্ পর্যায়ে পৌছে তা বলার অপেৰা রাখে না। সেই জন্যই পত্রিকায় তাঁর কথা লেখা হবে জানতে পেরে তিনি বলেছেন, পত্রিকায় লিখে কি লাভ? আমাকে তো কেউ আর দেখতে আসে না!
পত্রিকায় তাঁর কথা অবশ্যই লিখতে হবে, তাঁর খোঁজ নিতে হবে, তাঁর জন্য সবকিছু করতে হবে__ এটাই আমরা মনে করি। তাঁর অনেক পরিচয়। দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ,মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন ভাষাসৈনিক। তিনি সারাজীবন ভালবেসেছেন এই দেশকে, দেশের মানুষকে। ভালবেসেছেন দেশের মানুষের প্রাণের প্রিয় ভাষা এবং সংস্কৃতিকে। ভালবেসেছেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশের স্বাধীনতাকে। সংগ্রাম করেছেন, জীবনের মূল্যবান সময়ও এর জন্য কাজে লাগিয়েছেন। সর্বোপরি তিনি একজন দেশপ্রেমিক। আজ তিনি অসুস্থ। বার্ধক্যে উপনীত। ইচ্ছা করলে জীবনে অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু লোভ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তিনি বিত্তবান হতে পারেননি। বিরাশি বছর বয়স চলছে। এ সময় তিনি কি তাঁর সারাজীবনের পরিবেশ ও পরিম-ল থেকে বাইরে পরিত্যক্ত অবস্থায়, বিস্মৃত অবস্থায় এবং প্রায় বিনা চিকিৎসায় সময় কাটাবেন? এটা শুধু কি তাঁর একার দুঃখ, একার আফসোস! এ দুঃখ ও আফসোস সবার হওয়া উচিত।
দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের পৰের সরকার। এই চিরসংগ্রামী মানুষটির জন্য আমরা কেউ কি কিছু করতে পারি না? সরকারেরও উচিত হবে প্রবীণ এই রাজনীতিকের পাশে দাঁড়ানো।

No comments

Powered by Blogger.