হিলা বিয়ে প্রসঙ্গে ইসলাম by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

তিন তালাকপ্রাপ্তাকে তালাকদাতা স্বামীর জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে এই শর্তে বিয়ে দেয় যে, ওই ব্যক্তি বিয়ের পর তাকে তালাক দেবে। এই বিয়েকে হিলা বিয়ে বলে। ইসলামে এ ধরনের বিয়ের কোনো সুযোগই নেই। অথচ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবিষ্ট এই ফিতনায় জাতি আজ ক্ষতবিক্ষত।
একশ্রেণীর লোক এটাকে ইসলামসম্মত বলে দাবি করে থাকে। এ দাবি আদৌ সঠিক নয়। হিলা নিয়ে আলোচনার শুরুতে আসুন জেনে নিই এ সম্পর্কে কোরআন কিছু বলে কি-না?
পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় আল্লাহতায়ালা তালাক সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, যেখান থেকে তথাকথিত হিলার বিধানটি পরিষ্কার হয়ে যায়, সেখানে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, 'তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোনো স্বামীর সঙ্গে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোনো পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা, যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়।' সূরা বাকারা : ২৩০
এ আয়াতের অর্থ হলো, তালাক দেওয়ার কাজটি নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করা হলে যদি ওই মহিলাটি কোনো ধরনের বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া স্বাভাবিক নিয়মে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, অতঃপর যদি সেই স্বামী মৃত্যুবরণ করে অথবা ওই মহিলাকে নিয়ম অনুযায়ী তালাক দেয় এবং ইদ্দত (তালাকের পর তিন মাস অতিবাহিত করাকে ইদ্দত বলা হয়) পূর্ণ করে, তাহলে উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে আগের স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হতে পারবে।
ইসলামী শরিয়তের দর্শন হলো, তালাক যেন না হয় অথবা যে কোনোভাবে তা ঠেকানো যায়। ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হলেও এটা যাবতীয় জায়েজ কাজের মধ্যে নিকৃষ্টতম হিসেবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উল্লেখ করেছেন।
শরিয়ত অনুযায়ী তিনবারে তিন তালাক হওয়ার পর কোরআনের আয়াত মোতাবেক তাদের মধ্যে আর পুনর্বিয়ের সুযোগ থাকে না। ইসলাম এখানে শক্ত ভূমিকা নেওয়ার কারণ হলো, যাতে তালাকের প্রচলন কমে যায়। অথচ এই বিধানের অপব্যাখ্যা করে প্রচলন করা হলো ঘৃণ্য হিলাপ্রথা।
অবশ্য একটি কথা না বললেই নয়, হিলার একটি মানবিক দিক আছে। যদিও যারা এ প্রথার প্রচলন করেছিলেন, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল আমরা জানি না। দেখা যায়, গ্রামে-গঞ্জে যৌতুকের মতো গুরুতর কারণে যেমন তালাক হয়, তেমনি ভাত রাঁধতে বা বেড়ে দেওয়া দেরি হওয়ার মতো তুচ্ছ কারণেও স্বামী রাগের মাথায় তিন তালাক উচ্চারণ করে বসে।
তালাক দেওয়ার পর রাগ কমে গেলে, সন্তানের টানে কিংবা সংসার টিকিয়ে রাখতে স্বামী-স্ত্রী আকুল ও মরিয়া হয়ে ওঠে। সুতরাং তাদের পুনর্মিলনের উপায় হিসেবে হিলার প্রয়োগ ঘটে থাকে। হিলা প্রবর্তনে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে থাকলেও তা জায়েজ নয়। মানবিকতার অজুহাতে ইসলামের মূলনীতি থেকে বিচ্যুতির কোনো অবকাশ নেই।
অবস্থা বিশেষে উপকারিতা থাকলেও সামগ্রিক বিচারে তা নারীর জন্য অবমাননাকর; অধিকাংশ ক্ষেত্রে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী, মতলববাজ, লম্পট, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হীনস্বার্থ চরিতার্থের মাধ্যম। প্রায়ই প্রভাবহীন ব্যক্তির সুন্দরী স্ত্রী বা সম্পত্তি কৌশলে করায়ত্তের লক্ষ্যেই হিলার ঘটনা ঘটানো হয়। তালাকের কারণে পুনর্মিলন কিংবা প্রভাবশালীর দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন_ উভয় ক্ষেত্রেই হিলার রায় দিয়ে থাকেন অল্প শিক্ষিত, গ্রাম্য মোল্লারা। অল্প শিক্ষিত বলেই সঠিক ইসলামী আইন সম্পর্কে মূলত তারা অজ্ঞ। আবার কেউ ব্যক্তিত্বশূন্য, ফলে প্রভাবশালী সমাজপতির মুখের ওপর সত্য বলায় সাহসহীন। এছাড়া এদের অনেকেই দরিদ্র। আর্থিকভাবে তারা প্রভাবশালীর ওপর নির্ভরশীল থাকে। ফলে নিরুপায় হয়ে এমন অপকর্মে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়।
হিলা নামক এমন বেআইনি বিয়ে প্রতিরোধে দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা ও যথাযথ ইসলামী জ্ঞান। তাহলেই হিলার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে আমাদের ভাগ্যহত মা-বোনেরা। আর বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা সমালোচনা করেন, তারা বাদে অজ্ঞতাবশত ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধানের বিরূপ সমালোচকদের ভ্রান্তি অপনোদনও সহজতর হবে। এ জন্য আমাদের সুশিক্ষিত আলেমদের আরও কার্যকর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার। সময়ের কাজ সময়ে না করে পরে আফসোস করে লাভ নেই। আর যুগ চাহিদা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকারও কোনো সুযোগ নেই। muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.