জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা-শেষ-যাচ্ছেতাই অ্যাম্বুলেন্সসেবা পথেই অনেক মৃত্যু by তৌফিক মারুফ ও ওবায়দুর রহমান মাসুম

আধুনিক চিকিৎসা উপকরণে সমৃদ্ধ একটি অ্যাম্বুলেন্সে রোগী বহনকালেও রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়। এতে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটা কমে। তবে এ দেশে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে ব্যবহৃত সরকারি বা বেসরকারি বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সেই এসব সুবিধা নেই।
ফলে হাসপাতালে আনার সময় মারা যায় অনেক রোগী। একাধিক চিকিৎসক কালের কণ্ঠকে এমনই তথ্য দেন।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনের সভাপতি অধ্যাপক এইচ কবীর চৌধুরী বলেন, নিয়ম হলো একটি অ্যাম্বুলেন্সে আইসিইউর প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা উপকরণ থাকবে। প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধও থাকতে হবে। আর এসব সুবিধা থাকলেই একজন মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে আনার সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, এ দেশে জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়েই এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা নেই, এটা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনায় কোনো নীতিমালা হচ্ছে না।
এ সুযোগে এখন রেন্ট এ কারের মতোই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা চলছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. এইচ এ নাজমুল হাকিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল সার্ভিসের মধ্যে আগে হচ্ছে প্রি-হসপিটাল কেয়ার। এরপর হসপিটাল কেয়ার। রোগীকে হাসপাতালে প্রবেশ করানোর আগের চিকিৎসাটুকু খুবই জরুরি। এটার অভাবে বছরে অনেক লোকের মৃত্যু ঘটে। তিনি আরো বলেন, একটি অ্যাম্বুলেন্সে ভেনটিলেটর, অক্সিজেন, কার্ডিয়াক মনিটর, ইমার্জেন্সি ড্রাগসহ অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী উপকরণসহ আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) থাকা জরুরি, যা দেশের কিছু অ্যাম্বুলেন্সে থাকলেও বেশির ভাগেই এসবের কিছুই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতে গোনা কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে আধুনিক ও উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যক্তিগত ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের নামে এখন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শুরু হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের নামে পরিবহন ভাড়া। সাধারণ মাইক্রোবাস বা জিপে যন্ত্রাংশ সংযোজন করে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধিত হচ্ছে। তাতে অ্যাম্বুলেন্স লিখে চলছে রোগী পরিবহন। এ ধরনের বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সে আধুনিক জরুরি জীবন রক্ষাকারী কোনো সুবিধা নেই। এর সবচেয়ে বড় নজির দেখা যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায়।
ওই হাসপাতাল এলাকা ঘুরে জানা যায়, এখানে মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। আর দিনরাত হাসপাতাল কম্পাউন্ডের ভেতরে-বাইরে ভিড় করে থাকে ৫০-৬০টি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স। এগুলোর বেশির ভাগই সাধারণ মাইক্রোবাসের ওপরে সাইরেন-বাতি, ভেতরে খুবই সাধারণ মানের স্ট্রেচার। গায়ে কেবল বড় করে �অ্যাম্বুলেন্স� লেখা, ফোন নম্বর দেওয়া। কোনোটিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে, কোনোটিতে নেই। বেশির ভাগেই নেই অক্সিজেন ইউনিট। অনেকগুলোর গায়ে বিভিন্ন হাসপাতালের নাম লেখা। তবে প্রকৃতপক্ষে এগুলো কোনো হাসপাতালের নয়।
লাইট-সাইরেনসর্বস্ব সেবা : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাইক্রোবাস বা জিপে যন্ত্রাংশ লাগিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বানানো হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, চীন ও তাইওয়ান থেকে ফ্লাশিং ওয়ার্নিং লাইট, সাইরেন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আনা হয়। বাংলা মোটর ও বাংলাবাজারের মোটর যন্ত্রাংশের দোকানগুলোয় এসব যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্ট্রেচার ও অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে ৪০ হাজার টাকা খরচ করলেই একটি মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে ফেলা যায়।
বিআরটিএ থেকে জানা গেছে, অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধিত গাড়িগুলো �ছ� সিরিয়ালের হয়। তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ঘুরে দেখা গেছে �গ� ও �চ� সিরিয়ালের মাইক্রোবাসও অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে চলাচল করছে।
ঢাকার কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতাল গেটে দাঁড়িয়ে থাকা বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সেই সতর্কীকরণ বাতি, সাইরেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। অনেক অ্যাম্বুলেন্সে শুধু একটি স্ট্রেচার রাখা হয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সে ডাক্তার দূরে থাক, একজন নার্সেরও উপস্থিতি নেই। কয়েকটি আবার পুরনো, লক্কড়ঝক্কড় মার্কা। এসব অ্যাম্বুলেন্সে করেই দেশের রোগী বহন করা হয়। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সগুলোও রূপান্তর করা হয়েছে মাইক্রোবাস বা জিপে যন্ত্রাংশ বসিয়ে।
নেই নীতিমালা : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ�বিআরটিএ অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দেয়। শর্তাবলি সাধারণ যানবাহন নিবন্ধনের মতোই। নিবন্ধন ফিও সাধারণ যানের মতো। ফলে খুব সহজেই একটি মাইক্রোবাস বা জিপ অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে চলাচলের অনুমতি পায়। বিআরটিএ সূত্র জানায়, ১৯৮৩ সালে মোটরযান বিধি প্রণয়নের সময় অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাপক প্রচলন ছিল না। ফলে অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধনের বিষয়ে আলাদা নিয়মের উল্লেখ নেই।
বিআরটিএ থেকে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামে অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন করায়। এ ছাড়া শ্রমিক-কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পকারখানাও প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধন করায়। বিআরটিএ থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএ ঢাকা উত্তর সার্কেল থেকে ১২৮টি এবং দক্ষিণ সার্কেল থেকে ১৭২টি অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধিত হয়েছে। সারা দেশে তিন হাজারের মতো অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে বলে জানায় বিআরটিএ সূত্র। নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্সগুলোর একটা বড় অংশ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আইয়ুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, �অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দেওয়ার সময় এতে অক্সিজেন, স্ট্রেচার এবং সর্বোপরি গাড়িটি চলাচলের যোগ্য কি না, তা দেখা হয়। তবে এতে কী কী সুবিধা থাকা দরকার, তা নিয়ে ভাবার সুযোগ আছে। এ বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আলাপ করে একটা ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করা হবে।�
ঢাকা মেডিক্যালকেন্দ্রিক ব্যবসা : জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় যত প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স থাকে, ওই হাসপাতালেরই ২৫-৩০ জন কর্মচারী ওই অ্যাম্বুলেন্সগুলোর মালিকানার সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ সরাসরি নিজে লোক রেখে এই অ্যাম্বুলেন্সের তদারকি করেন, আবার কারো ভাই বা আত্মীয়স্বজন দিয়ে এগুলো পরিচালনা করিয়ে থাকেন। এসব কর্মচারীর মধ্যে গার্ড, ওয়ার্ডবয়, সুইপারের সংখ্যাই বেশি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও কর্মচারীদের এ অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার বিষয়টি জানে বলে জানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র।
হাসপাতালটির একাধিক সূত্র জানায়, জরুরি বিভাগে সব সময়ই অবস্থান করে একশ্রেণীর দালাল। কোনো রোগীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন হলেই আগে দৌড়ে আসে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে যুক্ত দালালরা। তারা দরদাম করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে যায়। বসে থাকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো। রোগীর প্রয়োজনে কেউ ওই সরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিতে চাইলেও নানান অজুহাত দেখানো হয়।
অভিযোগ আছে, সরকারি হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুুলেন্সের চালকরাও ওই প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের চালক বলেন, �অনেক সময় জরুরি কোনো রোগীর জন্য অক্সিজেন দরকার হলে হাসপাতাল থেকে আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া করে নেই।� ওই চালক বলেন, এখানে ভাড়ার কোনো নিয়ম-নীতি নেই। যাত্রীর সঙ্গে দরদাম করে যে যেভাবে যেতে পারে, যায়। তবে কম সুযোগ-সুবিধার অ্যাম্বুলেন্সে ভাড়া কম হওয়ায় যাত্রীরাও এ ধরনের অ্যাম্বুলেন্সের দিকে বেশি আগ্রহী। ভালো বা বড় প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া অনেক বেশি। ভালো অ্যাম্বুলেন্সগুলোর কোনোটির ভাড়া ঢাকার মধ্যেই দুই-তিন হাজার টাকা পড়ে। আবার এসি বা অক্সিজেন নেই�এমন অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া মাত্র ২০০-৩০০ টাকাও আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদুল হক মল্লিক কালের কণ্ঠকে বলেন, �অনেক কিছুই চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায়, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে কিংবা অভিযোগ না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।�
অ্যাম্বুলেন্স আছে, তবে... : দুর্ঘটনাকবলিত বন্ধু সোহানকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের টেলিফোন নম্বরে ফোন করেন কাওসার হোসেন। হাসপাতালের টেলিফোন অপারেটর মনির তাঁকে বলেন, �বাইরে অনেক অ্যাম্বুলেন্স আছে, আমাদেরটা পাবেন না।� কাওসার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, �আমি বাধ্য হয়ে বাইরের একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দানকারী প্রতিষ্ঠানে ফোন করে রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাই।� নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, �আমাদের মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্স, যা সাধারণত ডাক্তাররা ব্যবহার করেন।�
অধ্যাপক এইচ কবীর চৌধুরী বলেন, �অ্যাম্বুলেন্সে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ডাক্তার না হলেও একজন প্যারামেডিক্স থাকা অপরিহার্য। আমরা এ ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যারামেডিক্স তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি।�

No comments

Powered by Blogger.