বিদায়ী সাল যে কথা জানিয়ে গেল by করুণাময় গোস্বামী

২০১০ সাল শেষ হয়ে গেল। ৩৬৫টি দিন কোন দিক দিয়ে চলে গেল বোঝাও গেল না। ২০১০ সাল শেষ হওয়া মানে একটি দশকের শেষ হয়ে যাওয়া। সে আবার যেনতেন দশক নয়। নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশক। সে জন্য এ দশকের গুরুত্বই আলাদা।
বিশ্বজুড়ে হিসাব-নিকাশ চলছে এ দশক কেমন গেল, কেমন যাওয়া উচিত ছিল। আর ২০১০ সাল হচ্ছে এই দশকের মুকুটতুল্য বছর। ফলে এর গুরুত্বই আলাদা। কারণ এ বছর ইঙ্গিত দিচ্ছে আগামী বছরটি কিভাবে শুরু হবে। ফলে সহস্রাব্দের প্রথম দশকের ভেতরে থেকেও ২০১০ সাল একটি আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনেও এর আগে উলি্লখিত সব কথাই সত্যি। আমরাও যেমন সহস্রাব্দের প্রথম দশকটির দিকে ফিরে তাকাব তেমনি শেষ বছরটির দিকেও বিশেষ লক্ষ রাখব কেমন করে সেটি কাটল, আর কী ইঙ্গিত সে দিচ্ছে ২০১১ সাল কেমন করে যাবে সে বিষয়ে। তামামি বলতে যা বুঝি আমরা, তেমন একটা সালতামামি নিশ্চয়ই নানা বিষয়ে হবে। আমরাও একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। আমাদের বিষয় হতে পারে শিক্ষা, বলতে পারি আমরা শিক্ষাতামামি করতে যাচ্ছি। শুরুতেই আমি বলব যে ২০১০ সাল বাংলাদেশে নানা পর্যায়ে শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর ছিল। গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের দিক থেকে। অনেক বকেয়া বিষয় এ বছর সমাপ্ত হয়েছে এবং অনেক নতুন বিষয় এ বছর শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমরা ২০১০ সালকে বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল শিক্ষাবর্ষ বলতে পারি এবং এও বলতে পারি যে এই বছরে যেসব কর্মকাণ্ডের সূচনা ঘটল, তা আগামী বছরকে বা আগামী অনেক বছরকে প্রভাবিত করবে।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে। অনেক দিন থেকেই শিক্ষানীতি নিয়ে কথা হচ্ছিল এবং বলা হচ্ছিল যে বাংলাদেশের পক্ষে এমন একটি অগ্রসর শিক্ষানীতি নিয়ে কাজ করা উচিত, যা দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। বলে রাখা ভালো, গৃহীত শিক্ষানীতি বলতে একেবারে চূড়ান্তভাবে অনড় কোনো ব্যাপার নেই। মানুষের চিন্তাধারা পাল্টাচ্ছে, সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে, উৎপাদন বণ্টনব্যবস্থা নানাভাবে বিন্যাসিত হচ্ছে এবং এসব ব্যাপারের সঙ্গে যেহেতু মানবসম্পদ উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে গৃহীত শিক্ষা-ভাবনাকেও সময়ে সময়ে মোড় ফেরাতে হবে। সে হয়তো হবে, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আরো উন্নত, আরো বিশ্বমুখী, আরো বিশ্বমানসম্পন্ন হয়ে উঠবে। তার জন্য আমাদের শিক্ষানীতির কোনো কোনো ধারা বা উপধারায় সংযোজন-বিয়োজন হতেই পারে। তবে একটি সুচিন্তিত শিক্ষা-ভাবনা যে নীতি আকারে পাওয়া গেল সেটাকে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা মনে করি। এ নীতির বাস্তবায়ন কঠিন হবে, তবে এই কঠিন কাজটি করার জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন সেটি গ্রহণ করতে আমাদের জাতীয় পর্যায়ে যে কোনো কুণ্ঠা নেই, তা স্পষ্ট হয়ে গেল। সেই সঙ্গে এ ব্যাপারটিও স্পষ্ট হয়ে গেল, এই শিক্ষানীতির ভেতরে যে জায়গাটি রয়েছে সেখানে সবাইকে অবস্থান দেওয়ার মতো পরিস্থিতি রয়েছে। এটা একটা ইনক্লুসিভ ধারণা এবং আমাদের মতো বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থাসম্পন্ন সমাজে এই ইনক্লুসিভ দৃষ্টিভঙ্গি একটি অত্যন্ত কার্যকর বিষয়। তা না হলে সহজে এগোনো যাবে না।
এ বছরই আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি গৃহীত হতে দেখলাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর থেকেই এ আইন নিয়ে কথা হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কথার আর শেষ হচ্ছিল না। এ বছরে এসে সব কথা শেষ হলো। আইনটি চূড়ান্ত হয়ে গেল। সে একটি চমৎকার বিষয়। তবে ব্যাপারটি আরো চমৎকার হবে যখন এই আইনটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হবে। এ আইনের বয়ান যেভাবে আছে, তা যেটুকু দেখেছি, তাতে আমার কাছে সব কিছু ভালোই মনে হচ্ছে। সংস্কারের সব কাজই সরকার করবে তা তো নয়। বেসরকারিভাবেও কাজ হতে হুেব এবং সরকারি কাজের চেয়েও পরিমাণে বেসরকারি কাজ বেশি হতে হবে। তা হলেই দেশের কাজে একটি প্রচণ্ড গতি ও উদ্দীপনা আসবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যে কাজটি করা খুব জরুরি তা হচ্ছে, যে পর্যন্ত আমাদের বেসরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত দায়িত্বশীল না হয়ে উঠছে, সে পর্যন্ত তাকে, শিক্ষার ক্ষেত্রকে সামনে রেখে বলছি, একটা প্রচণ্ড খবরদারির মধ্যে রাখা। আমরা এ খবরদারির ব্যবস্থাটাকে অবিলম্বে জোরদার করে তুলতে পরামর্শ দেব।
২০১০ সালে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রবর্তন করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, ছাত্রদের কোনোক্রমেই শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা যাবে না, কেউ যদি নির্যাতন করেন তা হলে তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। নির্যাতনের দায়ে এর মধ্যেই কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ আইনটি একটি অসাধারণভাবে অভিনন্দনযোগ্য বিষয়। বহু আগে থেকেই স্কুলপর্যায়ে বিশেষ করে ছাত্রদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানোর রেওয়াজ চলে আসছে। সেটা বন্ধ করা যাচ্ছিল না। ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে নির্যাতন না করলে ছেলেপেলে মানুষ হবে না। কিন্তু এ ধারণা যে সত্যি নয়, বরং তার উল্টো, সে কথা আর ভালো কথায় বোঝানো যাচ্ছিল না। ফলে আইন করতেই হলো। আইন করাটা এবং আইনের অধীনে শাস্তিদানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হয়েছে এবং ২০১০ সাল এ ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই সঙ্গে ইভ টিজিং রোধে সরকার যে আইন করেছে এবং তাৎক্ষণিক বিচার ও দণ্ডদানের ব্যবস্থা করেছে তা শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ছাত্রীদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকর অবদান রাখবে। ইভ টিজিং আমাদের দেশে ছোটখাটো আকারে আগেও ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে কেন যে সেটা ব্যাপক হয়ে উঠল সে ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান এখনো হয়নি। তবে প্রতিরোধমূলক আইনটি যে ত্বরিতগতিতে সম্পন্ন হয়েছে এবং এর অধীনে শাস্তিদানও চালু হয়ে গেছে, সে এক অসামান্য ঘটনা। ২০১০ সাল ইভ টিজিং রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেও উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বিনা মূল্যে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক প্রদানের যে সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে এবং তার বাস্তবায়ন যথাযথভাবে করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে তা-ও আমার কাছে একটি অসাধারণ ঘটনা মনে হয়েছে। কোটি কোটি বই বিতরণের আকারে নিয়ে আসা সে এক সামান্য চ্যালেঞ্জ নয়। এই চ্যালেঞ্জটি যে মন্ত্রণালয় গ্রহণ করতে পারল এবং তার বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগী হয়েছে তার জন্য আমরা এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে অভিনন্দন জানাই। ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটতে পারে। সেটা বিবেচ্য বিষয়ই নয়। ব্যাপার হচ্ছে, মন্ত্রণালয় যে এত বড় একটা কাজ সামাল দিয়ে উঠতে পারার বিশ্বাস রাখে এবং সেটাকে সামাল দিয়ে উঠতে পারে তাতেই বোঝা যায়, আমরা সত্যি সত্যি যোগ্য হয়ে উঠছি। কয়েক বছর এভাবে কাটলে, আমার যেমন মনে হয়, আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিতরণের ক্ষেত্রে একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
২০১০ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা প্রবর্তন করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণী পর্যায়ে জাতীয় পরীক্ষা প্রবর্তন খুবই একটি চমৎকার ধারণা। তবে এই অষ্টম পর্যায়ে এসে ছাত্ররা কী প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করল সে বিষয়টি পরীক্ষা গ্রহণের চেয়েও জরুরি। পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারটি খুবই ভালো, তবে ছাত্ররা যেন যথাযথ প্রান্তিক যোগ্যতা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেন এই পরীক্ষা পাস করে গরিব বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা কারিগরি শিক্ষায় চলে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রান্তিক মান নিশ্চিত করতে হবে। ২০১০ সালে সৃজনশীল প্রশ্নমালার পরিধিকে বিস্তৃত করা হচ্ছে। এই বিস্তার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে সব পাঠ্য বিষয়ই সৃজনশীল প্রশ্নমালার সঙ্গে যুক্ত হবে। তবে কথা থেকেই যায়, সৃজনশীল প্রশ্নোত্তরের বিষয়টি যেন কার্যকর হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য অতি ব্যাপক শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বিজ্ঞান শিক্ষাকে জনপ্রিয় করার জন্য যে ভ্রাম্যমাণ ডিজিটাল প্রচারণা-আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটিও এ বিষয়ে সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটি ভালো উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে লটারির সাহায্যে সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেটাকে চমৎকার ভাবা যায় না। এর জন্য পরীক্ষা গ্রহণই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তবে বোঝা গেল যে আরো মানসম্পন্ন স্কুল স্থাপনে আর দেরি করার সুযোগ নেই। ঢাকা শহরকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতি অঞ্চলেই সরকারি এবং সুযোগ্য বেসরকারি উদ্যোগে স্কুল-কলেজ স্থাপিত হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে মোটেই বিলম্ব করা সমীচীন নয়। লটারি কোনো মানসম্মত সমাধান সূত্র নয়, হতে পারে না।
সব কিছু বিবেচনায় এনে, যাবতীয় উদ্যোগের ভালো-মন্দ সব দিক বিবেচনা করে এ কথা বলতেই হবে যে ২০১০ সাল বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে সমসাময়িক ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছে। এ বছরে যেসব কার্যসূচি গৃহীত হতে দেখলাম তাতে আমরা আশা করতে পারি যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অচিরেই একটি মানসম্মত কার্যকর ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাবে। আমরা যে দেশের গণ্ডি থেকে, অঞ্চলের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বশিক্ষার দিকে তাকাতে পারছি এবং নিজেদের সে ব্যাপারে যোগ্য করে তোলার ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছি, ২০১০ সাল সে কথাই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.