বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা-যুক্তরাষ্ট্রের ১২ কংগ্রেস সদস্য বিপক্ষে by আবুল কাশেম

বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা না দেওয়ার দাবি যুক্তরাষ্ট্রে আগে থেকেই ছিল। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিক নিহত হওয়ার পর তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ড ছাড়াও টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর না করা।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য এবং ওয়েজ ও মিনস কমিটির সদস্য বাংলাদেশের জিএসপি বাতিলের আবেদন করে ইউএসএ ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ রেন কার্কের কাছে চিঠি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই ১২ আবেদনকারীর মধ্যে বাংলাদেশ ককাসের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ ক্রাউলিও রয়েছেন। আবেদন পাওয়ার পর রেন কার্ক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন। অন্যদিকে, জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেমস অব প্রেফারেন্সেস তথা আমদানির ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারকে অগ্রাধিকার দান) সুবিধা বাতিল না করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদের জোসেফ ক্রাউলির সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলা একাধিক ফ্যাক্সবার্তায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত ২১ ডিসেম্বর জোসেফ ক্রাউলি ও হোয়াইট হাউসের সিনিয়র ডিরেক্টর এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাফ নিকোলাস ডিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদের। একই দিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর মো. শফিকুল ইসলামও আলাদাভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আরেকটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠান।
এসব বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তাতে রাজি হননি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, সরকার জবাব প্রস্তুত করছে।
রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদের তাঁর বার্তায় বলেছেন, 'বাংলাদেশের শ্রমমানের দুর্বলতার কারণে দ্রুত জিএসপি সুবিধা পর্যালোচনা করার জন্য ১২ জন ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য সম্প্রতি ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ-ইউএসটিআরকে (যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) চিঠি লিখেছেন। এই ১২ জনের অনেকেই দেশটির ওয়েজ ও মিনস কমিটির সদস্য। ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে অন্যতম জোসেফ ক্রাউলির সঙ্গে আজ দেখা করে জোরালো অনুরোধ করে বলেছি যেন জিএসপি সুবিধা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা না হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির উল্লেখযোগ্য অংশই জিএসপি সুবিধার বাইরে। তা ছাড়া বস্ত্র ও পোশাক খাত যুক্তরাষ্ট্রে এ সুবিধা পায় না। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করলে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। তখন ক্রাউলি আমাকে জানান, কিছু কংগ্রেসম্যান রয়েছেন, যাঁরা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করার পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এটা কেবল গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নয়। বরং শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম চুক্তি বা টিকফা স্বাক্ষর না করাসহ অন্য অনেক ইস্যুর সমন্বিত ফল।'
বার্তায় একরামুল কাদের আরো বলেন, 'ক্রাউলি আমাকে বলেছেন, এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ইতিবাচক উন্নয়ন দরকার। না হলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব আরো খারাপ হতে পারে। এতে এ ধরনের পরিণতি চলতেই থাকবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ঢাকাকে আরো জানান, 'যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। আমি ইউএসটিআরসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী অন্য কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছি। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে 'থ্যাঙ্কস হলিডে'র আগে তাঁদের কেউই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাননি। তা সত্ত্বেও আমি হোয়াইট হাউসের সিনিয়র ডিরেক্টর ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাফ নিকোলাস ডিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে আলোচনার পর পৃথক একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। টিকফা, আমিনুল হত্যাসহ শ্রমিক অধিকার বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমি সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি।'
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর মো. শফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ২১ ডিসেম্বর পাঠানো এক ফ্যাক্সবার্তায় বলেছেন, 'তাজরীন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রের ১২ কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ও কর্মপরিবেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ রেন কার্কের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা লিখেছেন, শ্রমিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করে বাংলাদেশ উল্টোপথে হাঁটছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পর্যালোচনার দাবি করেছেন ১২ কংগ্রেসম্যান।'
শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, 'শ্রমিক অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের সরকার ও পোশাকশিল্প মালিকরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং কোন ধরনের কর্মপরিকল্পনা চলছে তা আমাদের কাছে ইউএসটিআর কার্যালয় থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে।' উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে এএফএল-সিআইও (দি আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন)-এর মামলা দায়েরের পর থেকেই জিএসপি সুবিধার পর্যালোচনা চলছে।
বার্তায় শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, "ওয়ালমার্ট যে বাংলাদেশ থেকে কাপড় আমদানি করছে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গ্রুপ বিভিন্ন এলাকায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালাচ্ছে। 'ফ্রম ইউএস টু বাংলাদেশ, নো মোর ওয়ালমার্ট ফ্যাক্টরিজ ডেথ' স্লোগান নিয়ে গত ২০ ডিসেম্বরও প্রতিবাদীরা মাউন্ট প্ল্যাসেন্ট ও সাউথ কেরোলিনায় (ওয়ালমার্টের আমদানি করা পণ্য খালাসে ব্যবহৃত সমুদ্রবন্দর) বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ করে রাখে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ওপর নানা পক্ষের চাপ বাড়ছে।"
এ অবস্থায় তাজরীন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর নেওয়া পদক্ষেপগুলোসহ শ্রমিক অধিকার রক্ষা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
৯০-পরবর্তী বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিলের হুমকি দিয়েছে। জবাবে বাংলাদেশও শ্রমিক অধিকার রক্ষায় নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেছে। এত দিন এভাবেই চলছে। সর্বশেষ পরিস্থিতিকেও বাংলাদেশ গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বিমানমন্ত্রী মোহাম্মদ ফারুক খান, বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সমন্বিত করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরতে একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে মোট ২৪টি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পোশাকশিল্পের কমপ্লায়েন্স নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০০৬ সালে একটি সমঝোতা চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। ওই চুক্তি মতে বাংলাদেশ কাজ করছে না বলে এএফএল-সিআইও অভিযোগ করেছে। এ অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও ২০০৭ সালে জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদন করে ইউএসটিআরে একটি মামলাও করে। বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে ওয়াশিংটনে প্রথমবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালের ৪ অক্টোবর। ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয়বারের মতো শুনানি হয়েছে গত বছরের জানুয়ারি মাসে। মামলাটি এখনো চলমান।
এর আগে ১৯৯০ সালেও এএফএল-সিআইও জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিলের দাবি করে রিট পিটিশন করেছিল শ্রমিক অধিকার ইস্যু নিয়েই। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনটি দেশের প্রত্যেকটি তৈরি পোশাক কারখানায় স্কুল প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনসহ নানা ধরনের সুপারিশ করেছিল। ওই সময় বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোসহ তাদের অধিকার নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইউএসটিআর পিটিশনটি বাতিল করে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.