কেটে গেছে ১৩ দিন, স্কুলে স্কুলে বই নেই, বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে

বিভাষ বাড়ৈ "কি বলব বলেন? হাইস্কুলে প্রায় সব বই-ই আমরা পেয়েছি। কিন্তু খুব সমস্যার মধ্যে আছে আমাদের প্রাইমারির বাচ্চারা। কোন কাসের বাচ্চাদেরই আমরা একটি বিষয়ের বেশি বই দিতে পরিনি।
অথচ মাসের প্রায় ১৫ দিন চলে গেল। এবার তো দোকানেও বই পাওয়া যাবে না। প্রতিদিন সকালে বইয়ের জন্য শিৰা অফিসে ফোন দিচ্ছি আর কর্মকর্তারা 'বই আসলে পাবেন' বলে ফোন কেটে দিচ্ছেন।" নতুন শিৰাবর্ষের ১৩ দিনেও বিনামূল্যের বই না পেয়ে বুধবার দুপুরে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এভাবেই অভিযোগ করলেন তেজগাঁও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিৰকরা। তবে কেবল এই প্রতিষ্ঠানই নয়, সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে রাজধানীর সেরা বিদ্যাপীঠ থেকে শুরম্ন করে সারাদেশের বই বিতরণের ব্যাপক সঙ্কটের চিত্র। সরকারীভাবে পুরো প্রক্রিয়াকে সফল বলে দাবি করা হলেও শিৰক, শিৰার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, সারাদেশে প্রাথমিক, দাখিল এবং কারিগরি সত্মরের বইয়ের খবর ভাল নয়। অধিকাংশ বিদ্যালয়েই ১/২টি, আবার কোথাও ৩/৪টি বই দিয়ে শিশুদের বিদায় দেয়া হয়েছে। সকল বিষয়ে শতভাগ বই পেঁৗছেনি ৬০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই। জানা গেছে, প্রাথমিক, দাখিল ও কারিগরি সত্মরে এ পর্যনত্ম ছাপাই হয়েছে ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৯ ভাগ বই। মাধ্যমিকের বই ৯০ ভাগ এবং ইবতেদায়ির ছাপা হয়েছে ৯৫ ভাগ। সকল সত্মরের সকল বিষয়ের বই শিশুরা কবে পাবে তার সঠিক তারিখ জানে না কেউ। সরকারী কর্মকর্তারা এক সপ্তাহ বললেও খোদ প্রকাশকরাই বলছেন, শিশুদের হাতে সকল বই পেঁৗছতে পুরো জানুয়ারি মাস লেগে যাবে। এদিকে বইয়ের সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই শুরম্ন হয়ে গেছে নানামুখী অস্থিরতা। বাংলাবাজার, নীলৰেতসহ বিভিন্ন বইয়ের বাজারে বিনামূল্যের বই বিক্রি হচ্ছে প্র্যাকেজ (এক শ্রেণীর সব বিষয়) আকারে। প্রতি প্যাকেজের মূল্য ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা। অনেক স্কুল বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে কেনার জন্য নির্দিষ্ট দোকানে পাঠিয়ে দিচ্ছে শিৰার্থী ও অভিভাবকদের। ইংরেজী মাধ্যমের বই দেয়ার আগেই বাজার থেকে কিনে ফেলেছে অধিকাংশ শিৰার্থী। বই দেয়ার ঘোষণার এক সপ্তাহেও বই পায়নি নিবন্ধিত কিংবা সরকারী শিৰাক্রম অনুযায়ী চলা কোন কিন্ডারগার্টেনের শিৰার্থীরা।
ৰমতা গ্রহণের কিছুদিন পরই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সকল পর্যায়ে বিনামূল্যে শতভাগ পাঠ্যবই বিতরণের ঘোষণা দেয় মহাজোট সরকার। আর এ লৰ্যেই এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সত্মরের ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ জন শিার্থীর জন্য মোট ১৮ কোটি ৮০ লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৭ কপি পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণের কাজ চলে। এর মধ্যে প্রাথমিক সত্মরের ৭ কোটি ৮০ লাখ ১০ হাজার ৯০৭ কপি, মাধ্যমিক সত্মরের ৭ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার ১০৯ কপি, এবতেদায়ী সত্মরের ১ কোটি ৭৪ লাখ ৫ হাজার ২৩১ কপি, দাখিলের ১ কোটি ৪৭ লাখ ২১ হাজার ৬৬৩ কপি, কারিগরি সত্মরের ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৪৩৭ কপি পাঠ্যবই ছাপার কথা। ইংরেজী মাধ্যমের জন্য আছে আরও ৫ লাখ বই। সরকারের পরিকল্পনার পথ ধরে গত ৩০ ডিসেম্বর বুধবার সকালে সচিবালয়ে ১১ জন শিৰার্থীর হাতে বই তুলে দিয়ে দেশব্যাপী বিনামূল্যের বই বিতরণের যুগানত্মকারী কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের পৰ থেকে সেদিন ঘোষণা দেয়া হয়, সকল জেলা ও উপজেলা শিৰা অফিসে সকল বই পেঁৗছে গেছে। আগামী ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সকল শিৰার্থীর কাছে বই পেঁৗছে যাবে। তবে, বিতরণ প্রক্রিয়ার এ পর্যায় এসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ মাধ্যমিক, এবতেদায়ী সত্মরের বই বিতরণ প্রায় শতভাগই সফল। কিন্তু পিছিয়ে আছে প্রাথমিক, দাখিলের কাজ।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজে খোঁজ নিতে গেলে কোন শিৰক-কর্মচারী তথ্য দিতে রাজি হলেন না। সকলেই বললেন, অধ্যৰ ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে হবে আপনাকে। তবে এর কিছুৰণ পরই এক শিৰক জানান, মাধ্যমিক সত্মরে সকল শ্রেণীতেই আমরা বই পেয়েছি। কিন্তু প্রাথমিকের অবস্থা ভাল নয়। অনেক শিশুকেই এখানও বই দিতে পরিনি। যাদের দিতে পেরেছি তাদেরও সব বিষয়ের বই দিতে পরিনি। ঐ শিৰক জানালেন, খুব শীঘ্রই বাকি বই পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে শিৰা অফিস। মতিঝিল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজে গিয়েও দেখা গেল একই অবস্থা। সরকারী স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিৰার্থী রয়েছে মতিঝিল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই প্রতিষ্ঠানেও প্রাথমিকের কোন শ্রেণীর শিৰার্থী তার ছয়টি বিষয়ের সব বই পায়নি। স্কুল কর্তৃপৰ জানিয়েছে, শিৰা অফিস থেকেও তারা সব বিষয়ের বই পাননি। এমনকি কবে পাবেন তারও কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ জানাতে পারছে না শিৰা অফিস।
বিএএফ শাহীন স্কুল এ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিকের শিৰার্থীরা জানিয়েছে, তাদের প্রতি শ্রেণীতেই ১/২টি বিষয়ের বই পায়নি। একই অবস্থা প্রাথমিকেরও। পঞ্চম শ্রেণীতে অংক, চতুর্থ শ্রেণীতে বাংলা ও সাধারণ বিজ্ঞান, তৃতীয় শ্রেণীতে বাংলা ও ধর্ম, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ইংলিশ ফর টুডে বাকি আছে। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের অবস্থা ঠিক একই রকম। তেজগাঁও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের একটি/দুটি করে বই পায়নি বিভিন্ন শ্রেণীর শিৰার্থীরা। আর প্রাথমিকের ৬টি বিষয়ের মধ্যে স্কুল পেয়েছে মাত্র একটি বই। ওয়াইডবিস্নউসিএ স্কুল এ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিকের বই পেলেও প্রাথমিকের একটি বইও পায়নি শিৰার্থীরা। কর্তৃপৰ জানিয়েছে, শিৰা অফিস থেকে তারা ইতিবাচক সাড়া পেলেও এখন পর্যনত্ম বই হাতে পাননি একটিও। গভঃ ল্যাবরেটরী স্কুলে প্রাথমিকের একটি বিষয়ের বই পায়নি শিৰার্থীরা। রাজধানীর স্বনামধন্য স্কুলে বই বিতরণের চিত্রের চেয়ে করম্নণ অবস্থা সাধারণমানের ছোট ছোট স্কুলের। মাধ্যমিকের এক থেকে দুটি এবং প্রাথমিকের প্রতি শ্রেণীকে ছয়টি বিষয়ের ৩টির বেশি বই পায়নি কোন সাধারণমানের কোন স্কুলই। এদিকে বই না পেয়ে অনেক স্কুল বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে কেনার জন্য নির্দিষ্ট দোকানে পাঠিয়ে দিচ্ছে শিৰার্থী ও অভিভাবকদের। ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল কর্তৃপৰ হাতে পায়নি একটি বইও। কর্তৃপৰ অভিভাবকদের বলে দিয়েছে, ১৫ তারিখের মধ্যে বই না দিতে পারলে বাইরে থেকে কিনে নেবেন। সিভিয়েল এ্যাভিয়েশন উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপৰ শিশুদের হাতে দিতে পেরেছে ১/২টি বই। আর অভিভাবকদের হাতে বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, আর বই পাওয়া যাবে না। বাইরে থেকে কিনে নেবেন। কিন্তু বাইরে থেকে বই কিনতে না পেরে চরম বিপাকে পড়েছে শিৰার্থী ও অভিভাবকরা।
মঙ্গলবার ও বুধবার বাংলাবাজার, নীলৰেতসহ বিভিন্ন বইয়ের বাজারে গিয়ে দেখা গেল, বিনামূল্যের বই বিক্রি হচ্ছে প্র্যাকেজ (এক শ্রেণীর সব বিষয়) আকারে। প্রতি প্যাকেজের মূল্য ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা। তবে এসব বই বিক্রি হচ্ছে গোপনে। যাঁরা কিনছেন তাঁরা বলছেন, বই পাই না না পাই তারও ঠিক নেই। তাই কিনতে হচ্ছে। এদিকে ইংরেজী মাধ্যমের বই দেয়ার আগেই বাজার থেকে কিনে ফেলেছে অধিকাংশ শিৰার্থী। রাজধানীর বিয়াম স্কুলে গিয়ে দেখা যায় অনেক শিশুর হাতে নতুন বই। স্কুলের অফিসে কথা বলে জানা গেল, ইংলিশ মাধ্যমের বই বিনামূল্যে দেয়া হবে এই ঘোষণা দেরিতে হওয়ার আগেই অভিভাবকরা বই কিনে ফেলেছেন। বই দেয়ার ঘোষণার এক সপ্তাহেও বই পায়নি নিবন্ধিত কিংবা সরকারী শিৰাক্রম অনুযায়ী চলা কোন কিন্ডারগার্টেনের শিৰার্থীরা। জাতীয় শিৰাক্রম ও পাঠ্যপুসত্মক বোর্ডসহ বিভিন্ন শিৰা অফিসে বিষয়টি জানার জন্য খোঁজ নিচ্ছেন অনেক মানুষ। অন্যদিকে সিলেট বিভাগে চাহিদার তুলনায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বই পাঠানো হয়েছে। এর আবার মধ্যে পুরনো বইও রয়েছে। এ নিয়ে বিপাকে পড়ছেন সংশি-ষ্ট বিদ্যালয়ের শিকরা।
বরিশালের অধিকাংশ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীর ইংরেজী, ৪র্থ শ্রেণীর বাংলা ও বিজ্ঞান এবং তৃতীয় শ্রেণীর ইসলাম ধর্ম বই পেঁৗছেনি। মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে ৫৫ হাজার বইয়ের চাহিদা। মাদ্রাসা শিার েেত্রও বিরাজ করছে একই শূন্যতা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিকরা। তবে সংশি-ষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা অবশ্য দিচ্ছেন আশ্বাস। জানুয়ারির মাঝামাঝি সব বই পাওয়া যাবে বলে বলছেন তাঁরা। চট্টগ্রাম প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিা বোর্ডের প্রায় ৯০ শতাংশ পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ শুরম্ন হয়েছে। এই বিভাগের অবস্থা সবচেয়ে ভাল বলে জানা গেছে। তবে বিষয় হিসাবে এখানেও প্রাথমিকের অবস্থা খারাপ।
ঢাকা জেলা শিৰা অফিসার রম্নহুল আমীন খান জানিয়েছেন, জেলায় মাধ্যমিকের ৯০ শতাংশেরও বেশি বই চলে গেছে স্কুলগুলোতে। দাখিলের ৩৯টি বইয়ের মধ্যে ৯টি আমরা পেয়েছি। তিনি বলেন, প্রথম দিন হিসাব করলে হয়ত সকলে বই পায়নি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ইতিহাসের যে কোন সময়ের তুলনায় ভাল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত দেশের সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলই বিনামূল্যের বই পাবে। এনসিটিবি সূত্র জানায়, এবার এনসিটিবি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ৪০০ প্যাকেজ, ইবতেদায়িতে ৪০, দাখিলে ৭০ এবং কারিগরিতে ১০ প্যাকেজের কার্যাদেশ দিয়েছে। এসব প্যাকেজ কার্যাদেশ নিয়েই যত বিপত্তি বেধেছে বলে জানা গেছে। কোন বইয়ের একাংশ এক প্যাকেজে, অন্য অংশ অন্য প্যাকেজে হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ বই পেতে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। মূলত কার্যাদেশ সংশিস্নষ্ট বিপত্তির কারণেই বই পেতে এ বিলম্ব হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.