নতুন অধ্যায়ের শুরু- মাসুদা ভাট্টি

পৃথিবীর যে কোনও দেশে বা জাতিরই কিছু ঐতিহাসিক ত থাকে, সেগুলো সেই রাষ্ট্র বা জাতিকে যুগের পর যুগ ধরে তাড়া করে ফেরে। ভারতীয় জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ড কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত দিয়ে হিরোশিমা নাগাশাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা বিশ্ব বিবেকের কাছে এই রাষ্ট্র দু'টিকে অপরাধী করে রেখেছে।
ঠিক তেমনই বাঙালি জাতি কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সুস্থ মানুষের চোখে অপরাধী করে রেখেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার ঘটনা। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর কখনও খুনীদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করে, কখন্ও তাদেরকে মামলা থেকে অন্যায্যভাবে অব্যহতি দিয়ে, কখনও বা বিচারক নিয়োগে গড়িমসি করে, অথবা বিজ্ঞ বিচারকদের বিব্রত হতে বাধ্য করে এবং মামলার বাদিকে ভয় ভীতি প্রদর্শন তো আছেই। সুতরাং, রাষ্ট্রীয় ও ঐতিহাসিক এই কলঙ্ক থেকে বাঙালি জাতি কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে এরকমটি হয়তো অনেকেই ভাবেননি। কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না। তারা একে নির্বাচনী ইস্যু বানিয়ে শুধু মতায় যেতে চায়। নইলে ১৯৯৬ সালে মতায় এসে দলটি কেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার স্পেশ্যাল ট্রাইবুনালে করেনি? আজ এসব সকল প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে।
২৮ জানুয়ারি ২০১০-এর ভোরটি ছিল অন্যরকম, একটি ভারমুক্ত সকালে বাঙালি জাতি শুরু করেছে তার নতুন পথচলা। এতোদিন এই পথে বিছানো ছিল নানাবিধ কাঁটা। জাতির জনককে হত্যার পাপ, শিশুহত্যা, নারীঘাতের অমার্জনীয় অপরাধ জগদ্দল পাথরের মতো বসেছিল প্রতিটি বাঙালির ঘাড়ের ওপর। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনাকে কেবল একটি হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। এটা ছিল একটি জাতিকে সম্পূর্ণ বিনস্ট করে দেয়ার উদ্বোধন। বাঙালি জাতি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো যে সকল ঘটনাবলী যেমন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ দখল তেমনই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল বাঙালি জাতিকে অপশক্তির দখল করে নেয়ার মতো ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের মতো বাঙালি দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। একথা জোর দিয়ে এ কারণেই বলা যায় যে, এর পর থেকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়েছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থার ভেতর পড়েছে, রাষ্ট্রকে খুনীর ভূমিকায় দেখা গেছে এবং সর্বোপরি বাঙালি না থেকে শাশ্বত সনাতন বাঙালি না হয়েছে একটি শক্তিশালী জাতি পরিচয় দেয়ার মতো দৃঢ়চেতা। হাঁসজারুর মতো বাঙালি না ঘরকা না ঘাটকা ধোপার গাধার মতো শুধু জীবনের ভার বহন করেছে এবং বংশবৃদ্ধি করেছে। একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একটি জাতির জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা ভবিষ্যতে কেউ যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও তার পরবর্তী পটপরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন তাহলে বুঝতে সম হবেন, আশা করি ভবিষ্যতের কোনও গবেষক এই কাজটি করবেন। এলোমেলোভাবে এ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে কিন্তু সুসংগঠিতভাবে এই গবেষণার কাজটি অতি দ্রুত শুরু হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গকে হত্যাকারীদের পাঁচজনকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি প্রদানের ঘটনায় সবচেয়ে যে কথাটি বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে সম হয়েছে তাহলো, আইনের উধের্্ব কেউ নেই। অন্যায়কারীকে আজ হোক কাল হোক একদিন না একদিন আইনের সামনে দাঁড়াতে হবেই এবং আইন যদি দোষী সাব্যস্ত করে তবে শাস্তি তাকে পেতেই হবে। হয়তো তাতে তিন চার যুগ সময়পেণ ঘটতে পারে কিন্তু শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। আজ সকালে তাই সাধারণ মানুষ চায়ের কাপে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কথাটি নির্দ্বিধায় বলেছে যে, অন্যায়কারীর শাস্তি হয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি কতো রকম কায়দায় দীর্ঘ ৩৪ বছর ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল, ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখনও পর্যন্ত দেশের বিরোধী দল এই রায় সম্পর্কে টু-শব্দটি করেনি। যেনো এতো বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও তাদের আসলে কিছুই এসে যায় না। অবশ্য আজ তাদের অস্তিত্বই থাকতো না যদি পঁচাত্তরে জিয়াউর রহমান-এর প্রত্য মদদে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা না হতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি বলেই কি আজ বিরোধী দল মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে? কে জানে? রাজনীতি বড়ই নির্মম এবং নোংরা। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতা কি এটুকু বুঝতে পারছেন না যে, তার কিংবা তার দলের এই চুপ করে থাকাটা আসলে তাদেরকে জনগণের সামনে খুনীর কাতারে নিয়ে ফেলছে? অবশ্য তিনি বা তার দল জনগণের দৃষ্টি কিংবা জনগণকে থোড়াই কেয়ার করেন। তারা চাইলেই জনগণের ভোট ছাড়াই মতায় যেতে পারেন এবং হয়তো ভবিষ্যতেও যাবেন কিন্তু আজকের দিনে বেগম জিয়ার চুপ করে থাকা আসলেই বিস্ময়কর এবং বেদনাদায়কও। জামায়াতে ইসলামী খুব স্বাভাবিক কারণেই চুপ করে থাকবে। তাদের জন্মশত্রু শেখ মুজিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই তারা চায়নি ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা স্বাধীনতার স্থপতির হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর ঘটনায় খুশী হতে পারবে না। তবে কি বিএনপি এবং জামায়াত এখন সম্পূর্ণ একীভূত হয়ে গেলো? হবেও বা। রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং প্রকৃতিতে দল দু'টি ভেতর যে খুব একটা পার্থক্য আছে তা কিন্তু নয়। বরং এদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের নৈকট্যই এই দলদু'টিকে একত্রে সরকার গঠনে এবং এখনও একমঞ্চে রেখেছে। যদিও রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্র মতার স্বাদ পাইয়ে দেয়ার যে পাপ বিএনপি করেছে তাতে আসছে প্রজন্ম দলটিকে কী শাস্তি দেয় তা আসলে দেখার বিষয়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেই শাস্তির কিছুটা প্রমাণ আমরা দেখেছি কিন্তু এখনও তা থেকে শিা না নিয়ে দলটি যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আগামিতে এর মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করতে হবে বলে যে সকল রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তা আসলে মোটেও ভুল বলে মনে হয় না। নইলে আজ এই দলটি এতো বড় একটি জাতীয় ঘটনায় চুপ করে থাকে কোন্ যুক্তিতে? যেখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দণ্ডভোগের ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে বাঙালি জাতি যে কলংকমুক্ত হয়েছে সে কথা আন্তর্জাতিকভাবেই উল্লেখিত হয়েছে পত্রপত্রিকার সংবাদ কিংবা সম্পাদকীয় নিবন্ধে এবং সুশীল সমাজের কাছে, সেখানে এই নীরবতা পালন আসলে খুনীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ এবং প্রকারান্তরে এই খুনের দায়ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়ার দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়ার মতো মনে হচ্ছে।
আমার দেশী ও বিদেশি কিছু সুশীল বন্ধুরা বলতে চাইছেন যে, বিচার হয়েছে ভালো কথা কিন্তু আধুনিক ও সভ্য বিশ্বে খুনীদের ফাঁসি প্রদানের বিষয়টি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের উদ্দেশ্যে কেবল এই কথাটিই বলতে চাই যে, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতেই সময় লেগেছে ৩৪ বছর। এর মধ্যে খুনীরা ধিকৃত হওয়ার বদলে হয়েছে পুরষ্কৃত। শুধু তাই-ই নয় জেলের ভেতর বিচারাধীন অবস্থায় তাদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক ক্যাডারদের দিয়ে দেশে অরাজকতা অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার প্রধানকে হত্যার হুমকি সহ নানাবিধ ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে এই খুনীদের হাতে। আজও যারা দেশের বাইরে পলাতক অবস্থায় আছে তারা অনবরত গোটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে ফাঁসিদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলে তারা যে আবার সরকার পরিবর্তনের পর মুক্ত হয়ে নতুন করে অপকর্ম ঘটাবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? আজকে বিরোধী দল এই দণ্ড কার্যকর হওয়ার পরও চুপ করে আছে, মতায় এলে তারা যে খুনীদের সর্বত্র জামাই আদরে রাখে তার প্রমাণ তো আমরা আগেও দেখেছি। সুতরাং, আমার ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট-বিরোধী বন্ধুদের কাছে অনুরোধ জানাবো বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে দেখার জন্য। আমি নিজেও এই বর্বর রাষ্ট্রের হাতে মানুষ হত্যার বৈধতাকে মেনে নিতে পারি না। বিচারকের ভুল হতে পারে, মানুষ ভুল করতে পারে এবং এর ফলে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি হয়তো কখনও এর শিকার হতে পারেন। কিন্তু তাই বলে এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড কিংবা একটি জাতিকে হত্যাকারীদের বিচারের েেত্র রাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে আমি সমর্থন করি, নইলে আসলে এই কলঙ্কতিলক আমাদের কপালে যুগের পর যুগ বহন করতে হতো। ভাবতে অবাক লাগে এখনও এই খুনীদের পরিবারের একজন সদস্যও অনুতপ্ত নয়। কী করে মানুষ খুনকে তারা বৈধতা দিচ্ছে এবং মিডিয়ায় তা আবার ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে তা ভেবে বিস্ময় মানতে হয়। আজকে যে কষ্টের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছেন ৩৪ বছর আগে এর চেয়েও ভয়াবহ কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে ৭৫ এর কালো রাতে নিহতদের পরিবারের সদস্যবর্গ। এবং গত ৩৪ বছর ধরে গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের কুফল ভোগ করেছে এবং মাশুল গুনেছে। আসলে আমাদের সভ্য হতে এখনও দীর্ঘ সময় লাগবে।
সবকিছুর পরও আজকের ভোর সম্পূর্ণ অন্যরকম। ইতিহাসের যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট আজ তা থেকে আমরা মুক্ত। ২৮ জানুয়ারি ২০১০ হোক তাই বাঙালির নতুন ইতিহাসের উদ্বোধনী দিন।
পাটুরিয়া ঘাট, ২৮ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। ২০১০।
বট্রলঢটঠদর্টর্ধআদর্মবটধফ.ডমবস্ন

No comments

Powered by Blogger.