সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা ॥ সহায়ক শিক্ষার নামে স্কুলে স্কুলে অনুমোদনহীন বই- অসাধু ব্যবসায়ী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা জড়িত, এ্যাকশনে যাচ্ছে এনসিটিবি

 সরকারের বিনামূল্যের সহায়ক (বাংলা ব্যাকরণ ও ইংলিশ গ্রামার) বই সরবরাহে বিলম্ব কাজে লাগিয়ে দেশব্যাপী সক্রিয় হয়ে উঠছে অসাধু ব্যবসায়ী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।
সরকারী আদেশ সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সহায়ক শিক্ষার নামে শুরু হয়েছে নৈরাজ্য। ‘অনুমোদনহীন সহায়ক বই পড়ানো যাবে না, পাঠ্যসূচীতে রাখলে শাস্তি’ সরকারের এ কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করে বইয়ের বাজার দখলে নিয়েছে এরা। কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ছেয়ে গেছে অনুমোদনহীন ও নিম্নমানের সহায়ক বইয়ে। সহায়ক শিক্ষার নামে ঢুকে পড়েছে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটির অসংখ্য বই। প্রকাশকদের সঙ্গে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের বিনিময়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এসব বই পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে চাপিয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। অনুমোদনহীন বই পড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবদারও করেছে কয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এদিকে রাজধানীর বাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রিরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
পুরো ঘটনা নিয়ে আজ কালের মধ্যেই কঠোর এ্যাকশনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অবৈধ সহায়ক বই শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অর্থ আত্মসাত, বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রিসহ সকল অনিয়ম খতিয়ে দেখতে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের নিয়ে মাঠে নামছে র‌্যাবের বিশেষ টাক্সফোর্স। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফছুরুল আমীন বলেছেন, বই নিয়ে কোন ধরনের অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনহীন বই শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষক নেতারাও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের অনুমোদনহীন কোন অবৈধ বই প্রতিষ্ঠানে চলতে পারবে না। আমরা কঠোর এ্যাকশন নেব। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এনসিটিবির সহপাঠ বা সহায়ক বই নিয়ে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই উদ্বেগজনক চিত্র। জানা গেছে, এবারই দেশে প্রথমবারের মতো বিনামূল্যে সহায়ক বাংলা ব্যাকরণ ও ইংলিশ গ্রামার বই দিচ্ছে সরকার। কিন্তু সকল শ্রেণীর পাঠ্যক্রম নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে সরবরাহে সামান্য দেরি হয়ে যায়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকারের আদেশ লঙ্ঘন করছে অসাধু ব্যক্তিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে অবৈধ বইয়ের দাপটে প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে বোর্ড অনুমোদিত বৈধ ও মানসম্মত বইগুলো। জানা গেছে, সহপাঠ এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মূল বই নিয়েও দেশজুড়ে নৈরাজ্যের পাশাপাশি কোটি কোটি টাকার অনৈতিক বাণিজ্য চলছে। বাংলাবাজার, নীলক্ষেতসহ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার বইয়ের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এনসিটিবির অনুমোদনের বাইরে প্রায় পাঁচ শ’ বই বাজারে ছাড়া হয়েছে। আগেই স্কুলে অনুমোদনহীন সহায়ক বই পড়ানো নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশ করেছিল এনসিটিবি। একই সঙ্গে গতবছর সরকারীভাবে অনুমোদন দেয়া হয় ২৩ সহায়ক বইয়ের। এসব বইয়ের নির্ধারিত মূল্যসহ তালিকা জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিস এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) সকল আঞ্চলিক কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এনসিটিবি এবং মাউশি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, অনুমোদন পাওয়া বই ছাড়া বই পড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বইয়ের তালিকা চূড়ান্ত করে অনুমোদন দেয়া বইগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে এনসিটিবি। ১১ বিষয়ের বইয়ের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার এ্যান্ড কম্পোজিশন ও র‌্যাপিড রিডার। সপ্তম শ্রেণীতে বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার এ্যান্ড কম্পোজিশন এবং র‌্যাপিড রিডার। অষ্টম শ্রেণীতেও বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার এ্যান্ড কম্পোজিশন এবং র‌্যাপিড রিডার নামে সহায়ক বইয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। এ ছাড়া নবম শ্রেণীর সহায়ক বইয়ের মধ্যে আছে বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যসূচীতে রেনেসাঁ প্রকাশনীর অখ্যাত বই বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা বিচিত্রা এবং চৌধুরী এ্যান্ড হোসাইন সম্পাদিত এ্যাডভান্সড লার্নারস কমিউনিকেটিভ ইংলিশ গ্রামার এ্যান্ড কম্পোজিশন বই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর দনিয়া একে উচ্চ বিদ্যালয় এ্যান্ড কলেজে কর্তৃপক্ষকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে অনুমোদনহীন বই পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের বিভিন্ন শ্রেণীতে সহায়ক হিসেবে অননুমোদিত একাধিক বই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ড. দেলোয়ার মফিজের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও রচনা, হোসনে আরার কিশোরদের অমর কাহিনী, মোঃ আবু তাহের সরকারের বাংলাদেশ ও বিশ্বের ডায়েরি, মোঃ বাহাউদ্দিনের নিউ মেথড কমিউনিকেটিভ ইংলিশ গ্রামার এ্যান্ড কম্পোজিশন, মিয়া মোঃ আমিরুল ইসলামের বেস্ট স্টোরিজ অব কমিউনিকেটিভ ইংলিশ, এএসএম মাহবুবুল হকের মডার্ন ভোকাবুলারি উইথ সিনোনেম এ্যান্ড এ্যান্টোনেম। শেরেবাংলানগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও বিভিন্ন শ্রেণীতে সহায়ক বই হিসেবে দেলোয়ার মফিজের ভাষাশৈলী (বাংলা) ব্যাকরণ ও রচনা, আবু তাহের সরকারের বাংলাদেশ ও বিশ্বের ডায়েরি, আবুল কালাম আজাদের সীমানা- মাধ্যমিক ভূগোল ও সামাজিক বিজ্ঞান, মোহাম্মদ খলিলুল্লাহর এ পটেনশিয়াল ইংলিশ গ্রামার কম্পোজিশন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এনসিটিবি অনুমোদিত বই তালিকায় রাখলেও রাজধানীর নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, উদয়ন স্কুল, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় এ্যান্ড কলেজসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই পড়ানো হচ্ছে অনেক অনুমোদনহীন বই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ঘটনা এড়িয়ে গেলেও অনুমোদনহীন বই পড়াচ্ছেন বলে স্বীকার করলেন কয়েক অধ্যক্ষ। অন্যদিকে ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ পাঠ্য তালিকায় না রাখলেও কৌশল পাল্টে শ্রেণী কক্ষে দুটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বই কিনতে ছাত্রীদের বলে দিচ্ছে। এ কাজটি করছে ওসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়া শিক্ষকরা। কোন দোকানে পাওয়া যাবে তাও বলে দেয়া হচ্ছে। এসব কাজ করা হচ্ছে গবর্নিং বডির সভাপতিকে কিছু না জানিয়েই। এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামাল উদ্দিন জানালেন, প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ সরকারের দেয়া বইয়ের বাইরের বই পড়ানোর জন্য আবেদনও করেছে আমাদের কাছে। আমরা অনুমতি দেইনি। বলেছি এটা সরকারের বিষয়। এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজধানীর নামীদামী এসব স্কুল ও কলেজে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটির ‘এসো জীবন গড়ি’ নামে একটি বই। আবদুল মান্নান তালিবের লেখা এই বইটি নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। বইটিতে আছে উগ্রভাবধারা প্রকাশের স্পষ্ট চিত্র। ঢাকার বাইরের চিত্রও একই। তবে এই অবস্থা চলছে মূলত জেলা ও উপজেলা সদরের স্কুলগুলোতে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, যত প্রতিষ্ঠান অনুমোদনহীন অবৈধ বই বাজারে ছেড়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বই আছে এই ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি। অথচ জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আছে নানা জঙ্গীবাদী ও জিহাদী বই প্রকাশের অভিযোগ। বিভিন্ন সময় মৌলবাদী জঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অনেক জিহাদী বই এই প্রতিষ্ঠানই প্রকাশ করেছে।
এদিকে বাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিনামূল্যের এসব বই অবৈধভাবে বাজারে সরবরাহ এবং বিক্রির পেছনে জড়িত জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিস এবং এক শ্রেণীর অসাধু মুদ্রণ ও বই ব্যবসায়ী। রাজধানীর বিভিন্ন বইয়ের দোকানে গিয়ে পাঠ্যবই দেখতে চাইলে প্রথমে বই দেখাতে বা বিক্রি করতে রাজি হননি বিক্রেতারা। যাদের অভিভাবক বা শিক্ষক বলে মনে হচ্ছে শুধু তাদেরই পাঠ্যপুস্তক বের করে দেখাচ্ছেন বিক্রেতারা। নীলক্ষেতের বাবুপুরা মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোকানেই ক্রেতা সেজে খোঁজ নিলে বই বিক্রির প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া রাস্তার পাশে বই বিক্রেতাদের বললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কেটের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বইয়ের সেট দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.