ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল ২শ’ ১১ বছরের পথপরিক্রমা- প্রাচ্যের ভেনিস

খোকন আহম্মেদ হীরা ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। গাঙ্গের (নদীর) অববাহিকার এ জেলার বয়স দু’শ’ বছর পেরিয়ে গেছে। প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র পলি জমে সৃষ্ট কয়েকটি দ্বীপ বরিশাল।
১৭৯৬ সাল পর্যন্ত বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামেই পরিচিত ছিল বরিশাল। প্রাচীনকাল থেকেই নদী ভাঙ্গন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা এ অঞ্চলের মানুষের পেশা কৃষি ও মৎস্য শিকার। গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত চন্দ্রদ্বীপে লোকবসতি কবে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাচীন পুঁথি থেকে ধারণা পাওয়া যায় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের জন্ম ৪ হাজার বছর পূর্বে। প্রাচীনকালে এই দ্বীপে ছিল অসংখ্য নদী-নালা।
বরিশালের বালাম চাল ॥ এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ায় নদী ও খালের সঙ্গে যুক্ত করেই প্রবাদ রচিত হয় ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’। বালাম চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এ জেলা।
দু’শ’ এগারো বছর পেরিয়ে ॥ ১৭৯৭ সালে বাকেরগঞ্জে প্রথম জেলা স্থাপিত হয় । ১৮০১ সালে বাকেরগঞ্জ থেকে জেলার সদর দফতর আনা হয় বরিশালে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ও ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিল খুলনা বিভাগের অন্তর্গত। এককালের বরিশাল জেলা শহর রূপ নিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় শহরে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরিশালের রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে নাম দিয়েছিলেন প্রাচ্যের ভেনিস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এ শহরের আত্মীয়তা ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।
প্রাচ্যের ভেনিস থেকে রতœগর্ভা ॥ এখানে জন্ম নিয়েছেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, বাংলার বাঘ বলে খ্যাত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কবি সুফিয়া কামাল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, নলিনী দাস, মনোরমা মাসিমা অমৃত লাল দে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল, কৃষক কুলের নয়নমণি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেক ক্ষণজন্মা নারী-পুরুষ। একুশে ফেব্রুয়ারি ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে বরিশালের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের রচয়িতা ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী এবং গানটির সুরকার ও শিল্পী আলতাফ মাহমুদ জন্ম নিয়েছেন এ জেলায়। আলতাফ মাহমুদের নামে নগরীতে রয়েছে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। এছাড়াও স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, বীরোত্তম আব্দুস সত্তার ও মেজর জলিলকে নিয়ে এখানকার মানুষ এখনও গর্ববোধ করেন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বরিশাল শহরে। একইভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অপর নেতা চারণ কবি মুকুন্দ দাসের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই শহরে।
ঐতিহাসিক দুর্গা সাগর ॥ ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ পরগনার তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সঙ্কট নিরসনে মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করেছিলেন। তার মা দুর্গা দেবীর নামে দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিবর্তে দুর্গাসাগর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জেলা প্রশাসন। দুর্গাসাগরের তিনদিকে তিনটি ঘাটলা ও দীঘির ঠিক মাঝখানে ৬০ শতক ভূমির ওপর টিলা রয়েছে। দুর্গাসাগরের অদূরেই রয়েছে অত্যাধুনিক বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক জাদুঘর। এ জাদুঘরটি বানারীপাড়ার চাখারে শেরেবাংলার জন্ম ভিটায় অবস্থিত। লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি প্রায় তিন’শ’ বছরের পুরনো।
চারণ কবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি ॥ যে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে বলে গেছেন, আমার জন্মস্থান বিক্রমপুর। এটা শোনা কথার স্মৃতি ব্যতীত আর কিছুই নয়। যে আবেষ্টনকে মানুষ জন্মভূমি নামে ভালবাসে ও শ্রদ্ধাভক্তি করেÑ তা আমার কাছে বরিশাল। সেই বরিশালেই চারণ কবি মুকুন্দ দাসের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি এখন কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তসহ কংগ্রেসের নেতারা মুকুন্দ দাসের এ বাড়িতেই আন্দোলন-সংগ্রামের কৌশল নির্ধারণের জন্য গোপন বৈঠক করতেন।
জীবনানন্দ দাশের বাড়ি ॥ নগরীর বগুড়া রোডের মুন্সীর গ্যারেজ হয়ে শীতলাখোলার দিকে রওনা হলেই চোখে পড়ে ‘ধানসিঁড়ি’ নামের একটি বাড়ি। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার নাম অনুসারে এ বাড়িটির নামকরণ করা হলেও বাড়ির মালিকানা অন্যের হাতে। বাড়ির ভেতর আগের আমলের সেই শাল, শিরীষ, আম, জাম, কেওড়া গাছের খোঁজ এখন আর পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ দাশের সাধের গোলাপ বাগানও কালের বিবর্তনে শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর এ বাড়িটিতে এখন কবির বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘরের দু’টি খুঁটি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারপরও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এ বাড়িতে। জেলা পরিষদ জীবনানন্দ দাশের বসতবাড়ির একপাশে একটি পাঠাগার তৈরি করে দিয়েছে। জীবনানন্দ দাশের পিতা সর্বানান্দ দাশগুপ্ত ১৯০৭ সালে বগুড়া রোডে এ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। তখন বাড়িটির নাম ছিল ‘সর্বানান্দ ভবন’।
খেলাধুলা ॥ বিশ শতকের প্রথমদিকে ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে বরিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মোহামেডান ক্লাব। এছাড়াও পুলিশ ক্লাব ও টাউন ক্লাব তখন শক্তিশালী ফুটবল টিম হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা নলিনী দাস বরিশালের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন।
যাতায়াত ॥ খাল-বিলে ভরা এ জেলার মানুষের এক সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল একমাত্র নৌকা। গয়নার নৌকা থেকে শুরু করে এখন যাত্রীসেবায় যুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল দোতলা-তিনতলা লঞ্চ। যোগাযোগের মাধ্যম নৌপথের পাশাপাশি আজ সড়ক পথে উন্নতি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.