সেরা অর্জন-এভারেস্ট জয়

অর্জন বিচারে ২০১০ সাল ছিল বাংলাদেশের এভারেস্ট বিজয়ের বছর। বাংলাদেশের ছেলে মুসা ইব্রাহীম এ বছরের ২৩ মে ভোর ৫টায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ (২৯ হাজার ২৯ ফুট) এভারেস্টে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে সারা বিশ্বে দেশের মুখ আরেকবার উজ্জ্বল করেছেন।
এটি একই সঙ্গে বাঙালির এভারেস্ট জয়ের বছরও বটে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরো দুজন বাঙালি বসন্ত সিংহ রায় ও দেবাশীষ বিশ্বাসও ২০১০ সালে এভারেস্ট চূড়ায় পা রাখেন। এ বছর মুসাসহ মোট তিনজন বাঙালি এভারেস্ট জয় করলেন।
অবিরাম তুষার ঝড়, শূন্যের বিশ ডিগ্রি নিচে রক্ত জমানো শৈত্যপ্রবাহ, অক্সিজেনের স্বল্পতা, বিশাল লটবহরসহ খাড়া উঁচু পর্বত বেয়ে মাস দেড়েক চলার পরিশ্রম�সত্যিই খুবই দুরূহ কাজ। পেশাদার পর্বতারোহী মাত্রই জানেন, যথাযথ শারীরিক যোগ্যতা, দৃঢ় মনোবল, নিয়মিত পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ ছাড়া মোটেই এভারেস্ট জয় করা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে রয়েছে পথখরচের বিরাট অঙ্ক। এত কিছুর পরও প্রতিবছরই দু-একজন এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে মারা যান কল্পনাতীত শীতল আবহাওয়ায় জমে। আবার অনেক অভিযাত্রী হারিয়ে গেছেন এভারেস্টের অসংখ্য মৃত্যুফাঁদের অতলে।
তরুণ অভিযাত্রী মুসা ইব্রাহীমকে এসব বাধা-বিপত্তির কোনোটাই দমিয়ে রাখতে পারেনি। নর্থ আলপাইন ক্লাবের ব্যানারে তিনি অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এভারেস্ট জয়ের। শেষমেশ সেই অসাধ্যটি তিনি সাধন করেন গত বছর। মোট ৪৫ দিনের এভারেস্ট জয়ের প্রকল্পে বেরিয়ে ৪১ দিনেই তা জয় করেন তিনি। পর্বত জয় ও চূড়া থেকে নেমে আসাসহ পুরো অভিযানে তাঁর সময় লেগেছে ৫৫ দিন।
নেপাল থেকে গত ১ জুন বিকেলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে ত্রিশোর্ধ্ব এ এভারেস্ট জয়ের নায়ক অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, �আমার একার নয়, এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক বিজয়। সবার অনেক দিনের আশা ছিল, এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। আমি সেই আশা পূরণ করতে পেরেছি।� মুসা আরো বলেন, �বাংলাদেশের মানুষের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল এভারেস্ট জয় করার। অনেকেরই ইচ্ছা ছিল এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার। তাঁদের মধ্যে আমি প্রথম হতে পেরে খুবই খুশি। গত ২৩ মে ভোর ৫টায় এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে যে কাজটি আমি করেছি, তাতে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আপনারা শুভ কামনা করবেন, দোয়া করবেন, যাতে আমরা এ ধরনের আরো অভিযান তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ করতে পারি। এ ছাড়া সব বয়সের মানুষই যেন নানা অভিযানে অংশ নিতে পারে, সে জন্যও দোয়া করবেন।�
ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বাঙালি বীরকে সংবর্ধিত করেন। এরপর দেশজুড়ে মুসা পেয়েছেন উষ্ণ অভিবাদন, ফুলেল শুভেচ্ছা, সম্মান আর সম্মাননা। গত ২ ডিসেম্বর তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ �ব্লু� পুরস্কার প্রদান করে। ক্রীড়াক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। বলা ভালো, মুসা ইব্রাহীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। এখন মুসার ইচ্ছা, সারা দেশের তরুণ-তরুণীদের পর্বতারোহণের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া। এ জন্য তিনি যথেষ্ট উঁচু একটি �ক্লাইমিং ওয়াল� নির্মাণেরও স্বপ্ন দেখেন।
মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচজন বাঙালি এভারেস্ট জয় করেছেন। ২০১০ সালেরই ১৮ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার এক পাহাড়ি ক্লাবের বসন্ত সিংহ রায় ও দেবাশীষ বিশ্বাস এভারেস্ট চূড়ায় ওঠেন। ২০০৪ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সত্যব্রত দাম ও শিপ্রা মজুমদার এভারেস্ট শৃঙ্গে পা রাখেন। শিপ্রা মজুমদার হচ্ছেন প্রথম ও একমাত্র বাঙালি নারী, যিনি এভারেস্ট জয় করেছেন। অর্থাৎ ২০১০ সালেই তিনজন বাঙালি এভারেস্ট জয় করেছেন। এদিক থেকে এ বছরটি ছিল বাঙালির এভারেস্ট বিজয়ের বছর। এটি একই সঙ্গে একটি রেকর্ডও বটে।
সেই ১৮৫২ সালে রাধানাথ শিকদার নামে আরেক বাঙালি এভারেস্টের উচ্চতা প্রথম নির্ধারণ করেছিলেন। তখনই তিনি বুঝেছিলেন, এর চূড়াই পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান। অনেকের মতে, �এভারেস্টের� নাম তৎকালীন ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জেনারেলের নামে না হয়ে হওয়া উচিত ছিল �রাধানাথ�। অবশ্য পর্বতটির আসল নাম পুরনো তিব্বতি �চমোলংমাই� হওয়ারও যথেষ্ট দাবি রাখে।

No comments

Powered by Blogger.