অপরাধ আলোচনার শীর্ষে-ইভ টিজিং ও গুপ্তহত্যা by মাসুদুল আলম তুষার

অপরাধমূলক ঘটনার ভয়াবহ বিস্তার না ঘটলেও ২০১০ সালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ছিল। দেশজুড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পুরোপুরি পায়নি।
জনবল বৃদ্ধিসহ পুলিশ বিভাগকে আধুনিক করা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হলেও এর কার্যকারিতা যথেষ্ট ছিল না। মহাপরিদর্শকসহ পুলিশ বিভাগে বড় ধরনের রদবদল হলেও জনগণের কাক্সিক্ষত সেবার মান সে তুলনায় বাড়েনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
�ক্রসফায়ার� ঘটনা তুলনামূলক কম হলেও র‌্যাব ও পুলিশের বিরুদ্ধে গেল বছর গুপ্তহত্যার নতুন এক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে; যদিও এ বিতর্কিত অভিযোগের দায় নিতে সম্মত নয় কোনো কর্তৃপক্ষ। সব ছাপিয়ে বছরের শেষ অংশে আলোচনার শীর্ষে পৌঁছায় ইভ টিজিং। বেশ কিছু প্রাণহানি ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বখাটেদের এ অপরাধকে চরম গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ্রসরকার ইভ টিজিংবিরোধী আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক বিচারের উদ্যোগ নিলে অপরাধ বিস্তৃতি
কিছুটা কমে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলছেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া গেল বছর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো ছিল। নতুন বছরে আরো উন্নতির আশাবাদ জানান তিনি।
বিগত কয়েক বছর মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তথা ক্রসফায়ার বন্ধের দাবিতে। গত বছর তুলনামূলক ক্রসফায়ারের ঘটনা চাপা পড়ে যায় �গুপ্ত হত্যা� অভিযোগের নিচে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে গিয়ে অনেকে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন বলে প্রায় অর্ধশত অভিযোগ জমা পড়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান মোতাবেক গেল বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ১২০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। তবে ক্রসফায়ার অথবা হেফাজতে মৃত্যু এ বছর যতটা সমালোচনার ঝড় তুলেছে, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে গুপ্তহত্যার অভিযোগ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে বেশ কিছু অভিযোগ উত্থাপন হয়েছে গুপ্তহত্যা বিষয়ে। নিখোঁজ অর্ধশত ব্যক্তির ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রহস্যজনক নীরবতা এ বিতর্ককে জোরালো করে।
গত ২৫ জুন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম ইন্দিরা রোডের এক আ�ীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেটকারে ধানমণ্ডি যাওয়ার সময় অপহ�ত হন। সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা তাঁকে আটক করেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। দীর্ঘদিনেও তাঁর সন্ধান না মেলায় তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন বলেই ধারণা করছেন স্বজনরা। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে যুবলীগ নেতা লিয়াকতের নিখোঁজ ঘটনা নিয়ে। বছরের প্রথমভাগে ১৭ এপ্রিল বাড্ডা কুড়িল এলাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে কয়েকজন আটক করে নিয়ে যায় ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর এলাকার মিজানুর রহমান মিজান, নাজমুল হক মুরাদ ও ফোরকানকে। পরে ঢাকা উদ্যানের পেছনে তুরাগ নদীর বালিতে তাদের লাশ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও বরিশালের মজনু খান, ঢাকার ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজন, লাল বাবু ও জালাল, হাসিবুল হক জনি, ঠাকুরগাঁওয়ের আকবর আলী ও রিপন, গাজীপুরের সেলিম, গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, ঝালকাঠির ব্যবসায়ী হুমায়ুন, নারায়ণগঞ্জের কাপড় ব্যবসায়ী সজল, নুরুল আমিন, সিদ্ধিরগঞ্জের আবদুস সালাম, পল্লবীর শহীদুল্লাহ সুমন, কাপাসিয়ার ফলবিক্রেতা সেলিম, মাদারীপুরের আকবর আলী সরদারসহ অনেকেই রহস্যজনক অপহরণ ও গুপ্তহত্যার শিকার বলে স্বজনদের দাবি।
এদিকে খুন, ডাকাতি, রাহাজানিসহ নানা অপরাধ ছাপিয়ে ২০১০ সালে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল �ইভ টিজিং�। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ অপরাধের সূত্রে হত্যা, আ�হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
বছরের শুরুতে ১৯ জানুয়ারি ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে আ�হত্যার পথ বেছে নেয় ঢাকার শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাশফিয়া আখন্দ পিংকি। ২৬ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার চাঠাটিপাড়া গ্রামের কলেজছাত্রী রুমা একই কারণে মারা যায়। ২৯ এপ্রিল স্কুলছাত্রী চাচাতো বোনকে ইভ টিজিং করার প্রতিবাদ করায় যাত্রাবাড়ীতে প্রাণ দিতে হয় মামুন হাওলাদারকে। ১৯ আগস্ট মুন্সীগঞ্জে ইভ টিজিংয়ের ঘটনায় স্কুলছাত্রী হাসনা রহমান সিনথিয়া আ�হত্যা করে। ১২ অক্টোবর ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন নাটোরের লোকমানপুর কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান। ২০ অক্টোবর তিনি মারা গেলে দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। ঘটনার রেশ না কাটতেই ২৭ অক্টোবর ফরিদপুরের মধুখালীতে চাঁপা রানী ভৌমিককে (৪৮) প্রাণ দিতে হয় ইভ টিজারদের হাত থেকে কন্যাকে রক্ষার কারণে। তাঁকে নির্মমভাবে মোটরসাইকেলচাপা দিয়ে হত্যা করে বখাটেরা। এ ঘটনা একপর্যায়ে আন্দোলনে রূপ নেয়। গত ১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের রূপালী রানী ইভ টিজিংয়ের অত্যাচার সইতে না পেরে আ�হত্যা করে। ১৭ নভেম্বর কুড়িগ্রামে স্কুলপড়�য়া নাতনিকে ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় খুন হন নানা আবদুস সোবান (৭৫)।
ইভ টিজিং সমস্যা পর্যালোচনার পর বছরের শেষভাগে সরকার ইভ টিজিং রোধে নতুন আইন প্রণয়ন করে। তাতে ইভ টিজিংয়ের অপরাধে তাৎক্ষণিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার ক্ষমতা দেওয়া হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতকে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের এক শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজনকে সাজা দিয়েছেন। এ অবস্থায় ইভ টিজিংয়ের প্রকোপ কিছুটা হলেও কমেছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও স্কুল-কলেজের সামনে টহল বাড়িয়েছে এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে। সভা-সেমিনারের মাধ্যমেও ইভ টিজিংবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে।

No comments

Powered by Blogger.