পোশাক কারখানায় আগুন- এবার প্রাণ গেল সাত নারী শ্রমিকের

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে স্মার্ট এক্সপোর্ট লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় গতকাল শনিবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাত নারী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে ছয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ির ফটকে তালা লাগানো থাকায় তাঁরা বের হতে পারেননি। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে শ্রমিকেরা শ্বাসরোধে মারা গেছেন।
নিহতদের পরিচয়: নিহত শ্রমিকেরা হলেন: ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলার নাসিমা খাতুন (১৭); সাছরার নাসিমা বেগম (২৮), বাতেনবাড়ির জোছনা আক্তার (২০) ও একই জেলার চরফ্যাশন উপজেলার চরকুল্লির লাইজু আক্তার (১৭)। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার কানুদাসকাঠির রাজিয়া আক্তার (১৬) ও মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকার উত্তরপাড়ার কোহিনূর আক্তার (১৬)। অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এসব পোশাকশ্রমিক মোহাম্মদ-পুর এলাকার বিভিন্ন বস্তিতে থাকতেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গতকাল বেলা পৌনে তিনটার দিকে স্মার্ট এক্সপোর্ট লিমিটেডের দোতলার পেছনে কাটিং বিভাগে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। দ্বিতীয় তলায় কাচের গ্লাস লাগানো থাকায় ওই তলা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকেরা তড়িঘড়ি করে অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে অন্য শ্রমিকদের পায়ের চাপায় পিষ্ট হন। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ আহত শ্রমিকদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রায়েরবাজারে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বিকেল চারটার দিকে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুনে পোশাক কারখানার সব যন্ত্র ও কাপড় পুড়ে গেছে।
সিকদার মেডিকেলের সহকারী অধ্যাপক অঞ্জন লাল ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় এই হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁরা ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে দু-তিনজনের মুখমণ্ডলে আগুনের তাপ লাগার চিহ্ন ছিল। পুলিশ জানায়, লাইজু নামের একজনের লাশ স্বজনেরা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ ওই লাশ উদ্ধার করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্মার্ট পোশাক কারখানার শ্রমিক মিজানুর রহমান জানান, এই পোশাক কারখানায় তিন পালায় কাজ চলে। দুপুর ও সন্ধ্যার পালায় ২৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করছিলেন। বেলা পৌনে তিনটার দিকে দোতলার পেছনের দিকে কার্টিং বিভাগে আগুন জ্বলতে দেখে শ্রমিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা চিৎকার করে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। এত মানুষ একসঙ্গে একটি সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পিষ্ট হন। এরই মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে না পেরে তিনি বারান্দা ধরে ঝুলে নিচে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচেন।
আরেক শ্রমিক রওশন আরা বলেন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন, সেটির ফটক বন্ধ। এ সময় ধোঁয়ায় তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এরপর তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে দৌড়ে অন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাঁর আর কিছু মনে নেই।
অভিযান পরিচালনাকারী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, সিগারেটের জ্বলন্ত অবশিষ্ট অংশ থেকে কিংবা বিদ্যুতের তারের ছিদ্র থেকে ঝুটে আগুন ধরেছিল।
আবদুল হালিম বলেন, আগে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলেও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়েছে বেলা পৌনে তিনটায়। কারখানা কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসে খবর না দিয়ে কর্মীদের দিয়ে আগুন ধরে যাওয়া ঝুট ও কাপড় সরানোর চেষ্টা করে। এতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁরা দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখেছেন। এ সময় শ্রমিক কিংবা পোশাক কারখানার কাউকে পাননি। তিনি বলেন, কারাখানাটিতে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকেরা পোশাক কারখানার সামনে জড়ো হয়ে নিহত সহকর্মীদের জন্য আহাজারি করছেন। এ সময় পোশাক কারখানাটি থেকে পোড়া গন্ধ বের হচ্ছিল। কারখানার নিচতলায় বেকারি ও কয়েকটি গাড়ি মেরামতের প্রতিষ্ঠান অক্ষত ছিল।
হাসপাতালের দৃশ্য: গতকাল বিকেলে রায়েরবাজারের সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বারান্দায় দেখা যায়, এক সারিতে পাঁচটি লাশ চাদরে ঢাকা। লাশের ওপর স্বজনেরা আছড়ে পড়ে বিলাপ করছেন। তাঁরা বলেন, তাঁরাই ছিলেন সংসারের উপার্জনক্ষম। তাঁরা লাশের ময়নাতদন্ত করাতে চান না।
নাসিমা বেগমের পাশে বিলাপ করছিলেন তাঁর স্বামী মো. শফিক। তিনি বলেন, ‘সকাল সাতটায় দুইজনে একসঙ্গে বাইর অইছি। সকালে নাসির সঙ্গে মোবাইলে কথা অইছিল। তখন তারে বলছিলাম, ঠিক সময়মতো আইসো। কিন্তু এহন আমি ছোট্ট দুইটা মাইয়া-পোলারে নিয়া কেমনে বাঁচুম।’
বিকেলে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক পোশাকশ্রমিকদের মৃত্যুর খবরে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে সরকার এবং স্থানীয় সাংসদ হিসেবে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। প্রতিমন্ত্রী পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবিরকে ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। রাতে নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে সাতটি লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আহত শ্রমিকদের একজন ঢাকা মেডিকেল ও পাঁচজন সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপতালে চিকিৎসাধীন। সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই নারী শ্রমিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এর আগে গত বছরের ২৪ নভেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান।

No comments

Powered by Blogger.