বিজয়ের মাসেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by ডা. মো. ফজলুল হক

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক, বাংলাদেশের স্থপতি সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আমলে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত, ২৩ বছরের ১৩ বছরই জেলজুলুম ভোগ করেছেন বাঙালি জাতিকে স্বৈরশাসনের হাত থেকে রক্ষার জন্য।
সেই স্বপ্নের চূড়ান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর মাত্র এক ঘণ্টা পর, অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখে তাঁকে। পাকিস্তানের সেনাদের ভাষা উর্দু, সাঁতার কাটতে জানে না, রাস্তাঘাট চেনে না, চেহারাও ভিন্ন। তাদের নিয়ে এলো ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাসায় স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই? তারাই এ দেশের আলো-বাতাসে লালিত মানুষ নামের কলঙ্ক- রাজাকার, আলবদর, আলশামস- এক কথায় যুদ্ধাপরাধী। তারা যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে মওদুদীবাদ নামক ভ্রান্ত ও অনৈসলামিক কাজে মানুষকে শুধু বিপথগামীই করেনি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাত ধরে নিয়ে গেছে ঢাকা থেকে বাংলার গ্রামগঞ্জে। সেনাদের বোঝানো হয়েছে, যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে বা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়, তারা সবাই কাফের, সে যদিও মসজিদের ইমাম সাহেব হন, তবু কাফের। তাদের ধরে শ্যুট করো (হত্যা করো)। দিনের বেলায় সেনাদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়েই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, লুট করেছে স্বর্ণালংকার, ব্যাংকের টাকা, খাদ্যের জন্য গরু-ছাগল। হত্যা করেছে নিষ্পাপ শিশু। বেয়নেট দিয়ে গর্ভবতী মায়েদের পেট চিড়ে বাচ্চাও বের করে হত্যা করেছে ওই যুদ্ধাপরাধী চক্র, এমনকি তারা কোমলমতি মেয়েদেরও নিয়ে গেছে, যাদের খোঁজ স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও তার মা-বাবা জানেন না তাদের অবস্থা কী? মা-বাবা তাঁদের সন্তানের জন্য আজও পথপানে চেয়ে আছেন, আমার সন্তান এসে মা বলে ডাকবে। আজও তাঁদের চোখের জল ঝরছে। এমনিভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ প্রায় ৩০ লাখ নিরস্ত্র নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণকবর রচনা করা হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সব জেলার বিভিন্ন স্থানে। তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচারের রায় ও এর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত বিলম্বিত হবে, ততই ওই পক্ষটি মাথাচাড়া দিয়ে সমাজে গুম, হত্যা, অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুরসহ দেশদ্রোহিতামূলক কাজের মাত্রা বেড়েই যাবে, যা ইতিমধ্যেই আরম্ভ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। তবে তাদের অন্যায়ের মাত্রা অনেক বেশি। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ তাদের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ মেনে নিতে পারছে না। মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে একটি স্বাধীন দেশ ও একটি স্বাধীন জাতি উপহার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু জেলজুলুম-নির্যাতন ভোগের মধ্য দিয়ে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শত্রুরা যদি তাদের সহযোগিতা না দিত, তাহলে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হতো না এবং দুই লাখ মা-বোনকে ইজ্জতও হারাতে হতো না। এত ঘরবাড়ি ধ্বংস হতো না। আমাদের মধ্যে এ ধরনের শত্রুতাও সৃষ্টি হতো না। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যেত সন্দেহাতীতভাবে। দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের ত্বরিত বিচার ও এর বাস্তবায়ন দাবি করছে। জাতি এ কলঙ্কের দাগ মুছে কলঙ্কমুক্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। এটাই সবার প্রত্যাশা এবং সময়ের দাবি। মানুষের এই দাবি পূরণে সবাইকে আবারও একাত্তরের মতোই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন মতাদর্শের লোক বা সংগঠন থাকতেই পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতাও রয়েছে। স্বাধীনতার অর্থ এমন নয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ যেটির পক্ষে রায় দেবে তার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে মানুষ হত্যার পথ বেছে নিতে হবে। দেশের নারী, শিশুহত্যার পাশাপাশি কোমলমতি মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক অত্যাচারের পর গুলি বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার অনুমতি ইসলাম দেয়নি বরং কোরআন শরিফের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ আছে যে হত্যার বিনিময়ে হত্যার বিধান। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যেক যুদ্ধাপরাধী একাধিক মানুষ হত্যা করেছে। তাই বলে একজনকে একাধিকবার ফাঁসি দেওয়া যায় না, যদি সে সুযোগ থাকত তাই করা উচিত ছিল। যেহেতু জীবন মাত্র একটি। তাদের আজ মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে, এমনকি তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতেও চায় না সমমনা রাজাকার ছাড়া। আজ থেকে প্রায় ৪১ বছর আগে এ নারকীয় ঘটনা ঘটলেও তাদের বিচার হচ্ছে না কেন? বিষয়টি দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মনে দানা বেঁধে আছে। এ সরকারকে ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট দিয়েও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে কেন? রাজাকার তথা যুদ্ধাপরাধী চক্রের বিচারকাজ বিলম্বিত করার জন্যই আজ ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, ছিনতাই, পুলিশের অস্ত্র লুট ও গায়ে পেট্রল ঢেলে হত্যার মতো ন্যক্কারজনক কাজের দ্বারা স্বাধীন রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের মতো অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা করছে। এরাই যুদ্ধাপরাধীদের নতুন প্রজন্ম। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় নেওয়ার বিকল্প নেই। তারা ধর্মের নামে রাজনীতির কথা বলে মানুষ হত্যা ও সম্পদের ক্ষতি করছে। এ দেশের একটি রিকশাও যদি ভাঙা হয়, তার জন্য রিকশাওয়ালা বা মালিকের কাছেই শুধু নয়, জাতির কাছেও এর হিসাব দিতে হবে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এ মাসেই হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিসমাপ্তি- এটাই এ দেশের স্বাধীনচেতা মানুষের প্রাণের দাবি। তবে তদন্ত হতে হবে নিরপেক্ষ ও সঠিক, যাতে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, মেডিসিন, সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিঙ্ বিভাগ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।

No comments

Powered by Blogger.