আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমাহীন অনিরাপত্তা by শাহরিয়ার কবির

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সম্পর্কে আড়াই বছর ধরে আমরা যে পরিমাণ উদ্বেগ প্রকাশ করছি, সরকারের নীতিনির্ধারকরা তার চেয়ে বেশি উপেক্ষা ও ঔদাসীন্য প্রদর্শন করেছেন।
ট্রাইব্যুনাল ভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে তুরস্ক থেকে মানবাধিকারকর্মীর পরিচয়ে বাংলাদেশে আগমনকারীদের অবাধে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ, আসামি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পর নির্বিঘ্নে প্রস্থান। দৈনিক জনকণ্ঠে গত ২৫ ডিসেম্বর (২০১২) ব্যানার হেডিং ছিল- 'ট্রাইব্যুনালে ব্রাদারহুড'। খবরে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী পরিচয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঢুকে পড়েন তুরস্কের ১৪ আইনজীবী। বাস্তবে তাঁরা সবাই মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য। যাঁরা ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরা যাচাই-বাছাই না করেই তাঁদের ঢুকতে দেন।
উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় বিস্তৃত মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতি ও নেটওয়ার্ক সম্পর্কে যাঁদের সামান্যতম ধারণা আছে তাঁরা জানেন, আল-কায়েদা ও তালেবানের গডফাদার এই সংগঠন পাকিস্তান ও বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর জ্ঞাতি ভাই। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রায় একই সময়ে ভারতের আবুল আলা মওদুুদি ও মিসরের হাসান আল পান্না একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম ব্রাদারহুড গঠন করেন। এদের রাজনীতি হচ্ছে জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। যারা বাধা দেবে তাদের হত্যা করে এরা ইসলামের নামে বৈধতা দিয়েছে। ওসামা বিন লাদেনের পর আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা মিসরের আইমান আল জাওয়াহিরি মুসলিম ব্রাদারহুডেরও গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন।
এর আগে পত্রিকায় দেখেছি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যে তুরস্ক বিগত শতাব্দীর শুরুতে ১৫ লাখ আর্মেনিয়ানকে হত্যা করে গণহত্যাকারীদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যে তুরস্ক এখনো কুর্দিদের ওপর গণহত্যা অভিযান অব্যাহত রেখেছে, যেখানে ক্ষমতায় বসে আছে জামায়াত ও ব্রাদারহুডের জ্ঞাতিরা, সেই তুরস্কের প্রতিনিধিরা কাদের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছেন, কাদের সহযোগিতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ট্রাইব্যুনালে ঢুকে আসামি ও তাঁদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, এটিও যদি কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা বিভাগ উপেক্ষা করে তাহলে সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কেউ বাংলাদেশে এসে ট্রাইব্যুনালে ঢুকে আসামি বা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। জামায়াতের ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে এ কারণে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। টবি ক্যাডম্যানকে যদি আমাদের ইমিগ্রেশন পুলিশ বিমানবন্দরে বাধা দিতে পারে মুসলিম ব্রাদারহুডের আইনজীবীদের কেন বাধা দেওয়া হলো না? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কি চিড়িয়াখানার মতো পর্যটনকেন্দ্র, যেকোনো পর্যটক যখন তখন ট্রাইব্যুনালে এসে ঘুরে বেড়াবেন?
ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে থেকে আমরা বলছি, বাংলাদেশে '১৯৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য দেশে ও বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা শুরু করেছে। তারা শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ভাড়া করেছে ১৯৭১-এর আইন, ট্রাইব্যুনালের গঠনপ্রক্রিয়া, বিচারের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ ও ব্যাহত করার জন্য।
গত ১৩ আগস্ট (২০১২) আমরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ সমমনা আরো পাঁচটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে ট্রাইব্যুনালের জনবল ও রসদের ঘাটতি সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করেছি, যার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত। ১৩ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে আমরা বলেছি, 'নিরাপত্তার অপ্রতুলতা গোটা ট্রাইব্যুনালের জন্য মারাত্মক সমস্যা। ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী, তদন্ত সংস্থা ও সাধারণ বিভাগের কর্মকর্তা এবং গোটা ভবনে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব আমরা লক্ষ করেছি। প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাসী ক্ষমতা ও নেটওয়ার্ক সম্পর্কে অবহিত থাকলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিরাপত্তা সম্পর্কে এ ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন করত না। আমরা মনে করি, ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিপন্ন করে এই বিচারকার্যে যুক্ত হয়েছেন। ২০০১-০৬ সালে জামায়াত যখন ক্ষমতার শরিক ছিল তাদের জঙ্গিরা আদালতের বিচারক, আইনজীবী ও নিরাপত্তা রক্ষাকারীদেরও হত্যা করেছে।'
গত ২৪ ডিসেম্বর (২০১২) নির্মূল কমিটির সংবাদ সম্মেলনে আমরা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং বেলজিয়ামের ড. জিয়াউদ্দিনের টেলিফোন সংলাপ রেকর্ড, পাচার ও প্রচারের ঘটনায় আবারও ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তাহীনতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছি, ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে বিচারক, আইনজীবী বা কয়েকজন কর্মকর্তার জন্য নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ। আমরা ট্রাইব্যুনাল ও ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বলেছিলাম, নিরাপত্তা নজরদারির অপ্রতুলতার কথাও বলেছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, প্রধানত গোয়েন্দা নজরদারির ব্যর্থতার কারণে আমাদের ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের কম্পিউটারে যেভাবে প্রতিপক্ষের তস্কর হ্যাকাররা অনুপ্রবেশ করেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পূর্বাহ্নে সতর্ক হলে তা বন্ধ করা যেত।
সম্প্রতি জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক একটি দৈনিক ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক নাসিম এবং বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ টেলিফোনের কথোপকথন এবং ইন্টারনেটে পত্রালাপের বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে, যা তারা পেয়েছে চৌর্যবৃত্তির দ্বারা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভ এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে। এ নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা ভঙ্গকারীদের জন্য ফৌজদারি আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে রক্ষার জন্য দৈনিক আমার দেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও ফৌজদারি আইন লঙ্ঘন করে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করে সংবাদপত্রের নীতিমালা, বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দণ্ডনীয় অপরাধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আমরা জানি না।
গত ১৩ আগস্ট (২০১২) সংবাদ সম্মেলনে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও সাধারণ বিভাগে লোকবল ও রসদের যে ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে, ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি কক্ষ ও করিডর সিসিটিভি ক্যামেরা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা গোয়েন্দা নজরদারির অধীনে থাকলে চেয়ারম্যান বা অন্য কারো কম্পিউটারে হ্যাকিং বা টেলিযোগাযোগ রেকর্ড করে বাইরে পাচার কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। নিরাপত্তাব্যবস্থা যথাযথ হলে তুরস্কের মৌলবাদী মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা নির্বিঘ্নে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে পারত না। ট্রাইব্যুনালের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং যেকোনো সময় আরো বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ কারণেই আমরা বারবার বলছি, ট্রাইব্যুনালকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো 'ট্যুরিস্ট স্পট' বা পর্যটনকেন্দ্র নয়। এই ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্গত।
২৬ ডিসেম্বর ২০১২
লেখক : ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি

No comments

Powered by Blogger.