স্বাধীনতা যুদ্ধে ইসলামী চেতনা by আলী হাসান তৈয়ব

কয়েকদিন পরই আমরা পালন করতে যাচ্ছি বিজয়ের ৪২তম দিবস। ১৯৭১ সালে আমরা যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের জুলুম-বঞ্চনা ও অবিচারের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। কারণ, ইসলাম কখনও কোনো জুলুম বা অন্যায় সহ্য করে না।
বরং জুলুম ও অন্যায় প্রতিরোধের জন্যই ইসলামে জিহাদের বিধান রাখা হয়েছে। ইসলামের জিহাদ কারও ভূমি-সম্পদ জবরদখলের জন্য নয়।
জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে সবার ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। লক্ষ্য একটাই, দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র কিংবা পরিবারের কাছে রণাঙ্গন থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্র দেখলেই সে কথা জানতে পারি। এসব থেকে আরও জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে যাওয়ার আগে আল্লাহর কাছে নামাজ আদায়ান্তে মোনাজাত করে রওনা হয়েছেন। বাবা, মা বা স্ত্রীর অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে চেয়ে তাদের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া আর কায়মনো প্রার্থনা শুনেই তারা ছুটেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
বছরখানেক আগে গিয়েছিলাম শেরপুরের সীমান্তঘেঁষা পল্লী মরিয়মনগরে। ওই গ্রামে একটি ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল_ ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী এবং শ্রেষ্ঠত্বের অনস্বীকার্য বাস্তবতা তুলে ধরতে। আলোচক হিসেবে সেখানে যাওয়ার সময় দুর্গম পথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সঙ্গে। নাম মনে না থাকলেও ভদ্রলোকের শ্মশ্রুমণ্ডিত টুপি-পাঞ্জাবি পরা ইসলাম অন্তপ্রাণ চেহারাটি মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে।
গাড়িতে পাশের সিটে বসে আমি দাদার বয়সী ওই মুরবি্বর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললাম। তিনি জানালেন, কয়েকদিন পরেই তিনি ঢাকায় আসছেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। তার মুখে এ প্রসঙ্গ শুনতেই আমার মনে হলো, তাকেই জিজ্ঞেস করা দরকার আমার দীর্ঘদিনের লালিত সেই প্রশ্নটি। আচ্ছা জনাব, আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন কী উদ্দেশে? কী অভিপ্রায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তরে? দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার উত্তর_ 'বাবা, আমরা লড়াই করেছি জালেম হটিয়ে মজলুমদের বাঁচাতে। ইসলামই আমাদের সে প্রেরণা জুগিয়েছে। ইসলাম কখনও জালেমের পক্ষে নয়। ইসলাম সবসময় জালেম নির্মূল করতে বলে। আমরা সবাই ফজর নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে বুক ভাসিয়ে মোনাজাত করেই তবে গেছি যুদ্ধক্ষেত্রে।'
বস্তুত স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে চলা চিহ্নিত একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া হক্কানি আলেমদের কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেনি। বর্তমানে অনেকেই না জেনে ঢালাওভাবে আলেম কিংবা টুপি-দাড়িওয়ালাদের স্বাধীনতাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছে, যা কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়। এর ফলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে। সমাজের সংহতির ভিত নষ্ট হবে।
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় হক্কানি ওলামায়ে কেরামরাও এ যুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বৈধ এবং উচিত লড়াই বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি মুফতি তাকি উসমানীর বিশ্ব ভ্রমণকাহিনীর বই 'জাহানে দীদাহ'-এর বাংলাদেশ ভ্রমণ অংশে এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ড. ইউসুফ আল-কারযাবির ভ্রমণকাহিনীর বাংলাদেশ অংশেও এ সত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ বলেছেন।

No comments

Powered by Blogger.