ডেসটিনির কর্মকাণ্ড জেনেও চুপ ছিল সরকার by ফখরুল ইসলাম

অনুমোদনহীন ব্যাংকিংসহ ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের খবর জেনেও নিশ্চুপ থেকেছে সরকার। এ নিয়ে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে।


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড ও ডেসটিনি গ্রুপের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। অথচ সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সূত্র থেকে পাওয়া বিভিন্ন চিঠিতে দেখা গেছে, ডেসটিনির কর্মকাণ্ডের বিবরণ একাধিকবার লিখিতভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী গত রোববার আরও বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বললে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ও ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, তিন মাস আগে, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়। ডেসটিনির বিষয়ে ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘এদের ব্যবসা প্রতারণামূলক ও জনস্বার্থের পরিপন্থী। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।’
একই দিনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও চিঠি পাঠায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ডেসটিনির কার্যক্রম সম্পর্কে একটি কমিটি গঠন করে ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। এর আড়াই মাস পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি ২০০০-এর অবৈধ কর্মকাণ্ড’ শীর্ষক ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তর বা রেজসকোর নিবন্ধক আহমেদুর রহিমকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়। বলা হয়, অন্য পাঁচ সদস্য হবেন—অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে উপসচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) একজন করে উপপরিচালক। সূত্র জানায়, প্রায় দুই মাস হতে চললেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত এসব সংস্থা নিবন্ধকের কাছে কোনো নামই পাঠায়নি।
ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সম্প্রতি চিঠি চালাচালি শুরু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। একটি অভিযোগের সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম প্রতারণামূলক উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখে যেন প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই চিঠি পাওয়ার পর একই বছরের ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানকে পাল্টা চিঠি লেখে। ওই চিঠিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এরপর দুই সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও ভিজিলেন্স বিভাগের এই দলের তৈরি করা প্রতিবেদন সম্প্রতি পাঠানো হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর কাছে।
যোগাযোগ করলে গতকাল সোমবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডেসটিনির প্রতারণামূলক কার্যক্রমের জন্য কয়েক মাস আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘ডেসটিনির ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা খুবই কম। যেমন, প্রতারণা করে থাকলে মামলা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারের দায়িত্ব পুলিশের। তারাও চুপচাপ।’ তিনি এ সময় জানান, অর্থমন্ত্রী এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। বৃহস্পতিবার দেশে ফিরবেন। এর পরেই ডেসটিনি নিয়ে একটি বহুপক্ষীয় তদন্ত কমিটি করা হবে।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখছি যে, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না।’
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন বলেন, ‘সব দায়িত্ব মনে হয় এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।’ তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ডেসটিনি বিষয়ে আজ কাগজপত্র সব গোছালাম। শিগগিরই কিছু দেখা যাবে।’
সূত্র জানায়, ডেসটিনির অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে এর কার্যক্রম চালুর শুরুর দিকেই অবশ্য প্রতারণার অভিযোগ উঠেছিল। ‘জিজিএন’ ও ‘নিউওয়ে বাংলাদেশ’ নামের দুটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের বিষয়ে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে বিনিয়োগ বোর্ডে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রতারণামূলক ব্যবসায় নিয়োজিত সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের আওতায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর তখনকার অর্থসচিবের কাছেও একটি চিঠি পাঠায়। এতেও বলা হয়, ‘ডেসটিনি ২০০০-এর কার্যক্রম প্রতারণামূলক।’
এসবের উদাহরণ টেনে ২০০৫ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটি চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে। এতে বলা হয়, ‘নিউওয়ে ও জিজিএনের মতো ডেসটিনি ২০০০-ও একই ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরূপ প্রতারণামূলক ব্যবসা সম্পর্কে সরকারি পর্যায়ে প্রতিবিধান ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার অভাবে জনস্বার্থহানিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
কিন্তু তখনকার জোট সরকারও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নেয়নি। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডেসটিনি তার কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান হয়েছে ৩৭টি।
এদিকে, ডেসটিনি গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের আয়কর ফাইল তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত রোববার মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর অফিসকে ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়কর বিবরণীর ফাইল এনবিআরের নিরীক্ষা, পরিদর্শন ও তদন্ত বিভাগে পাঠানোর নিদের্শ দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার এই ফাইল আসতে শুরু করেছে।
এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ফাইল তলবের কথা স্বীকার করে গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ডেসটিনির প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক ও যথাযথভাবে কর দিচ্ছে কি না, সেটা দেখা হবে। যদি প্রয়োজন হয়, তদন্ত করা হবে।
মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আরও জানান, এ ছাড়া সমবায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত ডেসটিনি প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে সদস্যদের মধ্যে লভ্যাংশ দিচ্ছে কি না, সেটাও বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।

No comments

Powered by Blogger.