মত ও মন্তব্য-নবীন-প্রবীণের স্মৃতি জাগানিয়া আনন্দযাত্রা by হারুন হাবিব

স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে নিজের ভালো লাগার কিছু জরুরি কাজ থেকেই গেছে। বিশেষ সংখ্যাগুলোর জন্য লেখালেখি। নানা জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ, স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদীদের উত্থানের বিরুদ্ধে সতর্কতা উচ্চারণ ইত্যাদি।


বরাবরের মতোই আমাদের জেনারেশনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের কথা বলার চেষ্টা করেছি নতুন প্রজন্মের মানুষকে। এরই মধ্যে ডাক আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের নৌবিহারে যোগ দেওয়ার। নতুন-পুরনো ছাত্রছাত্রীদের 'অ্যালামনাই'র উদ্যোগে বার্ষিক এই নৌভ্রমণটায় আগে যাওয়া হয়নি আমার। সহপাঠী ও নতুন বন্ধুদের কেউ কেউ আগ্রহটা বাড়িয়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত গেলাম।
উজানবাওয়া আনকোড়া নতুনের সঙ্গে দূরবাসী প্রবীণের দূরত্ব নতুন কিছু নয়। এ দূরত্ব যেমন শরীরের_মনেরও। কিন্তু বুড়িগঙ্গার ঘন কালো পানি পেরিয়ে আমাদের বহনকারী 'সুরভী-৮' জাহাজটি যখন মেঘনার স্বচ্ছ পানিছোঁয়া উদ্দাম বাতাসে চুল-হাত-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছুঁয়ে যেতে থাকে_তখন কে প্রবীণ, কে নবীন_বোঝার উপায় থাকে না। একেকবার মনে হতে থাকে, পানিতে নয় 'সুরভী-৮' ভেসে চলেছে স্বপ্নের শূন্যে, ডোরাকাটা বিহঙ্গের পাখামেলা বাতাসে; আর আমরা নবীন-প্রবীণরা সাতরঙা রথে উড়ে চলেছি অদেখা অনন্ত আনন্দ উদ্যানের পথে! জাহাজটি নোঙর তোলে ভোরবেলা, ঘাটে ফিরিয়ে দেয় সন্ধ্যারও পর। এরই মধ্যে খাওয়াদাওয়া, নাচ-গান, খেলাধুলা আর দুই পাড়ের মনলোভা দৃশ্য দেখে কেটে গেছে ৯টি ঘণ্টা। বলতে দ্বিধা নেই_পুরো সময়টায় জনাকয়েক প্রবীণ আমরা শত নতুনের উদ্দাম-উচ্ছ্বাসের হাতে বন্দি। বন্দিত্ব গ্রহণ করার যে অপমান_সে অপমান সইবার লোক নই আমরা। কিন্তু বলতে বাধ্য_সব বন্দিত্ব অপমানের নয়, বরং আকণ্ঠ পান করে তুষ্ট হওয়ার মিষ্টি অনুভবের। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের নতুন বন্ধুরা আমাদের প্রবীণদের সে অনুভব উপহার দিয়ে উপকৃত করেছে। আমরা উজ্জীবিত হয়েছি।
গুটিয়ে থাকা আমরা এবং ফুলবনের রঙিন প্রজাপতিদের অবারিত স্বদম্ভ বিচরণ দেখে পুরনোদের প্রথমেই ধারণা হয়েছিল_নতুনের এ আনন্দ মিছিল রাঙানোর সাধ্যি ওদের নেই। কাজেই জাহাজের পাটাতনে, নবীনদের থেকে দূরে নয়, একেবারে কাছেও নয়, বসেছিলাম আমরা ৯ জন_সত্তরের বন্ধুরা। দূরত্বটা সযতনে এমনই রেখেছিলাম যে নতুনের উন্মাদনার মোহময়ী বাতাস আমাদের রাঙাতে ব্যর্থ হলেও যেন উপেক্ষা না করে বসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিভাগেরই এককালীন কৃতী ছাত্র_আমাদেরও বেশ পরে। ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক বহু বছর তিনি। নৌবিহারে সস্ত্রীক এই অমায়িক অথচ সাহসী মানুষটি যোগ দেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের বাড়তি আনন্দ জুটেছে_বলাই বাহুল্য। কখনো-সখনো আগে ডিপার্টমেন্টে ঘুরতে যেতাম। যেতে হতো_মনেরই টানে। আমাদের তারুণ্যের স্মৃতিময় বিদ্যাপীঠ_যাকে দম্ভভরা চঞ্চল পদভারে কাঁপিয়ে দিয়েছি আমরা এককালে। উত্তাল ঊনসত্তর-সত্তর হয়ে রক্তাক্ত একাত্তর এবং তারও পর। ইতিহাস-সচেতনরা অবশ্যই মানবেন কী অপ্রতিরোধ্য সময় পেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের জেনারেশনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে! আজকের পুরনো সহপাঠীদের অনেকেই অবাধ্য, অনিরুদ্ধ সেই প্রতিবাদী সময়ের পাঁচালি গেয়ে থাকেন। বলেন, আমরা যা পেরেছি, দেখিস, এরা পারবে না। প্রশ্ন করি_কেন? বন্ধুটি বলেন, এরা ব্যস্ত, কোনো ক্রাইসিসে নেই; ক্যারিয়ার চাই, টার্গেট মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি_বিদেশ_স্বচ্ছন্দভোগী জীবন। আমরা জীবনকে এভাবে দেখিনি। দেখার সুযোগ ছিল না। জীবন এদের কাছে স্ট্র্যাটেজি_বেঁচে থাকার কৌশল মাত্র।
বন্ধুটির সব কথা সঠিক মনে হয়নি আমার। জীবনযাপনের স্বরূপ আজ থেকে ৪০ বছর আগে যেমনটা ছিল_তা নেই। স্বাভাবিক রূপান্তর। স্ট্র্যাটেজিস্ট হওয়ার মাঝে অমর্যাদার কিছু আছে বলে মনে হয় না আমার। জীবনযাপনের জন্য কৌশল দরকার; কিন্তু কৌশলই একমাত্র অবলম্বন হয় না জীবনের। নৈতিক বলসম্পন্ন মানুষ হওয়া যেমন বড়, দেশপ্রেমের আদর্শিকতার ওপর দাঁড়িয়ে বেড়ে ওঠা, পথচলাও বড়। বাংলাদেশ তৈরি করেছে আমাদের প্রজন্মের মানুষ তাঁদের রক্ত দিয়ে_সে ছিল তাঁদের আরাধ্য কাজ। বাংলাদেশকে রক্ষা করবে, সামনে এগিয়ে নেবে আজকের এবং আগামীর তারুণ্য_যা তাদের বড় কাজ। নতুনদের সংকট ও সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করি এবং এও জানি, ওরাই পারবে। আমরা পেরেছিলাম আমরা নতুন ছিলাম বলে_এরা পারবে এরা নতুন আছে বলে। যথার্থই বলতে হবে, ৪০ বছরের ব্যবধানে চঞ্চল পা আমাদের শ্লথ হয়েছে। বেশির ভাগ শরীর ঝিমিয়ে পড়ার জোগাড়। দু-চারজন ভালোই আছেন। জীবনযন্ত্রণা ভুলে যৌবনের আদলেই একরোখা হয়ে উঠতে পারেন। বেশির ভাগের চোখে ভারী লেন্স। সহপাঠী সিদ্দিকুর রহমান রসিকতা করে বলেন, এককালে চোখের এতই বেশি ব্যবহার করেছিস যে অকালেই চশমা! অস্বীকার করিনে দুরন্তপনা কম করিনি। যে সিদ্দিক নিজেও ছিল দুর্বার_সেও কি আগের মতো আছে? এককালের প্রায় অপ্রতিরোধ্য পুরান ঢাকার বন্ধু আবদুল মতিনকে দেখলাম মধ্যাহ্নভোজের পর চেয়ারেই ঝিমুচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে একপাল তরুণ-তরুণী মুখ টিপে হাসছে। যন্ত্রণাটা খোঁচা দেয় আমাকেও। দ্রুত চিমটি কেটে সহপাঠীকে জাগিয়ে দিলাম। বললাম, এই ওঠ?
পেশাগত জীবনে মাঝেমধ্যে ডিপার্টমেন্টে না গেলে যেন চলত না। এখন ও রকম হয় না। যেতে চাই, তবু না। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে বিস্তর জানাশোনা ছিল। 'সুরভী-৮'-এ কয়েকজনকে পেলাম। বিভাগের দীর্ঘকালীন শিক্ষক ড. আবদুস সালামকে দেখলাম বিরাট আয়োজন তদারক করছেন। ড. গোলাম রহমান সদ্য বিদেশ থেকে এসে আবারও যোগ দিয়েছেন বিভাগে। অনেক বছর পর দেখা ডিপার্টমেন্টের অফিস সেক্রেটারি মুজিবের সঙ্গে। সফেদ সাদা দাড়ি নিয়ে হাসতে হাসতে কাছে এসে বললেন, চিনতে পারছেন? চিনতেই পারিনি প্রথমে। সদাহাস্য সুঠামদেহী এই মুজিবকে কতই না জ্বালিয়েছি। সাংবাদিকতা বিভাগে আগে ক্লাস হতো সন্ধ্যাবেলা। এতে সুবিধা ছিল কারো কারো। নতুন দেশের নতুন সাংবাদিকতার কাজ সেরে ক্লাস করতে আমারও সুবিধা হতো। আমরা ছিলাম এমএ পর্বের দ্বিতীয় ব্যাচ। অনার্স তখনো চালু হয়নি। মনে পড়ে প্রথম বিভাগীয় প্রধান ও বিভাগের স্থপতি আতিকুজ্জামান খানের কথা। আতিকুজ্জামান খান এবং এ কিউ এম নূরউদ্দিন ছিলেন স্বাধীনতাপূর্বকালে সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাণশক্তি। নূরউদ্দিন স্যারকে বাসস পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল যখন জাতীয় সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল আমাকে। ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মুনিম, ড. সামসুল হুদা হারুন, শাখাওয়াত আলী খান, নূর হোসেন, হাসান সাঈদসহ আরো কয়েকজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা আমাদের নানা বিষয়ে পড়িয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের কথা মনে পড়লেই ফিরে আসে উত্তাল ঊনসত্তর, সত্তর এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ২ মার্চ, ১৯৭১। কলাভবনের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম তোলা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এ পতাকার সম্মান রক্ষায় ঘটে গেল রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যুদ্ধে যাওয়ার। গেলামও সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু সতীর্থ দিনাজপুরের আবদুল হালিম রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রইল পলাশী ব্যারাকের সামনে। গুলিতে ওর শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনারা ওর সঙ্গের প্রায় সবাইকে হত্যা করেছে। একসময় হালিমের জ্ঞান ফিরে আসে। সেনারা চলে গেলে লাশের মিছিল থেকে উঠে জীবন বাঁচায় বন্ধুটি। আজ কোথায় আছে কে জানে! মনে পড়ে, কলাভবনের সামনে দাঁড়ানো শক্তিমান ইতিহাসের সেই বটবৃক্ষ_সেই মধুর ক্যান্টিন, ছাত্রজনতার অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থান। সর্বশ্রদ্ধেয় দার্শনিক ড. জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিনসহ অসংখ্য শিক্ষককে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় দোসর আলবদর- রাজাকার। অগণিত নিরস্ত্র ছাত্রকে হত্যা করেছে ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে। মধুদাকে হত্যা করেছে গণহত্যায় মত্ত পাকিস্তানি সেনারা। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল যে বৃক্ষ_তাকেও সমূলে উৎপাটন করেছে ওরা। পাকিস্তানিরা হয়তো ভেবেছিল, এভাবেই বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে নস্যাৎ করা যাবে! কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষী বটবৃক্ষটির নতুন সংস্করণ ঘটেছে, নতুন চারাগাছ লাগানো হয়েছে ১৯৭২-এ, বেড়ে উঠেছে আরেক বটবৃক্ষ_যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বন্ধুরা আজ দেখছে।
আমাদের এক বন্ধু সাহাব উ আহমেদ। বন্ধুরা ওকে সাবু বলে ডাকে। তিন যুগেরও বেশি আমেরিকায় বসবাস করে এখন সে দেশেই নোঙর ফেলেছে। সেদিনকার সুদর্শন, সুগঠিত সাবুর চুল পাকলেও হৃৎপিণ্ড মেরামত করা হলেও আজও সে দুর্বিনীত, উদ্দাম। যে রকমটি ছিল ৪০ বছর আগে_ঠিক সে রকম। স্বাধীন মানুষের এমন নজির কমই পাওয়া যায়! নৌবিহারে যোগ দিয়ে মুক্ত এই বিহঙ্গ আনন্দ বাতাসে সাঁতার কেটেছে। আমাদের আরেক সতীর্থ টিএসসির পরিচালক আলমগীর হোসেন সজ্জন ব্যক্তি। বড্ড ব্যস্ত দেখাচ্ছিল ওকে নৌবিহার ব্যবস্থাপনায়। কয়েক শ তরুণ-তরুণীর কলকাকলিতে ঠাসা জাহাজ। গান ও নাচ; ছোটাছুটি, হৈ-হুল্লোড়, খাওয়াদাওয়া। সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে মেয়েরা, লোহার সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের ওপরকার ছাদে। যে মেয়েদের এক শ্রেণীর ভণ্ড রাজনীতিক ধর্মের অপব্যাখ্যায় দাবিয়ে রাখতে চায়, পদানত সেবাদাসী বানাতে চায়, শিক্ষা-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে চায়, স্পষ্ট দেখলাম, সেই মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে এখন। এ যেন নীরব বিপ্লব। ওদের কণ্ঠ, ওদের তেজ ও অপরাজেয় জিজ্ঞাসা, আমার বিশ্বাস, সরব বিপ্লব আনবে এ দেশে। সে বিপ্লবের পদধ্বনি যত স্পষ্ট হয় ততই অভাগা সমাজের মঙ্গল।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.