ছয় হাজার কোটি টাকা বঞ্চিত হচ্ছে সরকার- অবৈধ ভিওআইপি by ফিরোজ মান্না

 অবৈধ ভিওআইপির কারণে সরকার প্রতি বছর ছয় হাজার কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই টাকা সরকারের ঘরে তোলার জন্য বিটিআরসি বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
বাড়িয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। চালানো হচ্ছে একের পর এক অভিযান। বিটিআরসির কঠোর অবস্থানের কারণে গত চার দিনে বৈধ কলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে বৈধ গেটওয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় চার কোটি মিনিট কল বিদেশ থেকে দেশে আসছে। বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপির বিরম্নদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে বলে খবর মিলেছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) জিয়া আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, সরকার কোন গোষ্ঠীর স্বার্থ রৰার জন্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে না। কোন পৰপাতিত্ব না করে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করতে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। বৈধ পথে ব্যবসা করার সুযোগ থাকার পরও যারা এ ধরনের কাজ করছে তাদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া হবে না। অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে বিটিআরসি উচ্চ ৰমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা পরিদর্শন, পরীণ এবং শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে। কমিটিতে বিটিআরসির উর্ধতন কর্মকর্তা, র্যাব, বিটিসিএল ও টেলিটকের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা রয়েছে। বর্তমানে কমিটি উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করছে। জনগণের কাছ থেকে অবৈধ ভিওআইপি সংক্রানত্ম তথ্য পাওয়ার জন্য বিটিআরসির ওয়েবসাইটে তথ্য দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এ সংক্রানত্ম বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে একাধিকবার । গত এক বছরে অবৈধ ভিওআইপি কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি মোবাইল অপারেটরের ২ লাখ ৫০ হাজার ২৫০টি সিম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিটিআরসিতে স্থাপিত সিডিআর সিস্টেমের মাধ্যমে বিভিন্ন টেলিকম অপারেটরের ভুল বা বানানো ফোন নম্বরগুলো শনাক্তও করা হচ্ছে।
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন-২০০১ এর মতাবলে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভিওআইপি (ভয়েজ ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) হচ্ছে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি অবৈধভাবে ব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়ীগণ আনত্মর্জাতিক কল আদান প্রদানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরম্নদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কমিটি পুরোদমে কাজ শুরম্ন করেছে। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে যেই জড়িত হোক তাদের ধরা হবে। একই সঙ্গে বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপি কল বন্ধের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার সিদ্ধানত্ম নিয়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ কারিগরি জনবল। অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব আয় অনেক বাড়বে।
ঢাকা ফোনের পরে বিভিন্ন পিএসটিএন টেলিফোন কোম্পানিগুলোর কলরেট অস্বাভাবিক গতিতে কমতে থাকে। প্রতিদিন যাদের কলরেট ছিল ১৮ থেকে ২০ লাখ মিনিট তাদের কলরেট ৬ থেকে ৭ লাখ মিনিটে নেমে আসে। এতে বিটিআরসির সন্দেহ সৃষ্টি হয়। হঠাৎ করে পিএসটিএন কোম্পানিগুলোর কলরেট কমে যাওয়ার কারণ খুঁজতে শুরম্ন করে। এরপর তারা নিশ্চিত হয় যে বেশ কয়েকটি পিএসটিএন কোম্পানির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। পরে বৃহস্পতিবার সারা রাত অভিযান চলে র্যাংকসটেল ও ওয়ালটেলের কোম্পানিতে। র্যাংকসটেল থেকে জিএম টেকনিক্যাল কামরম্নজ্জামান, ডেপুটি ম্যানেজার মমিনুর রহমান ও জিএম সেলস এবং মার্কেটিং ইকবাল করিম ভুইয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের র্যাব হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের বিরম্নদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিটিআরসি। অবৈধ ভিওআইপি প্রতিরোধ কমিটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় গত এক বছরে ৫৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে ৪৭৭টি টেলুলার টার্মিনাল, ১৮টি চ্যানেল বক্স, ২৭টি গেটওয়ে, ২টি ভিস্যাট, ১টি এসটিএম, ও ১৬টি ই-১ এবং অন্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি উদ্ধার ও জব্দ করা হয়েছে। মামলা ২৯টি দায়ের করা হয়েছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের বিরম্নদ্ধে । অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এমন ২৪ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে তারা জামিনে বের হয়ে তাদের অনেকেই আবার ভিওআইপি ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, দেশের দু'টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও ম্যাংগো টেলিসার্ভিস লিমিটেড বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ডিপ প্যাকেট ইনিস্পেশন (ডিপিআই) পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি)-এর ডাটা ট্রাফিক সর্বণিকভাবে পর্যবেণ করছে। ডিপিআইএর মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি কাজে ব্যবহৃত আইপিগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আইআইজি দু'টির ডাটা ট্রাফিক অনলাইনে পরিবীণ করার জন্য বিটিআরসিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। গত এক বছরে এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৫০০০ (পনেরো হাজার) আইপি ঠিকানা বন্ধ করা হয়।
অবৈধ ভিওআইপি কাজে ব্যবহৃত সিমগুলো তৎণাৎ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এ কাজে ব্যবহৃত সিমগুলো শনাক্তকরণের জন্য বিটিআরসি বহুমাত্রিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অপারেটরদের তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় অবৈধ ভিওআইপি কাজে ব্যবহৃত সিম চিহ্নিতকরণে উদ্বুদ্ধ করা, এসএমএসের মাধ্যমে সিম নম্বর সংগ্রহ করা, বিটিআরসির অভিযোগ কেন্দ্রে প্রাপ্ত নম্বর জানানো, বিভিন্ন অভিযান থেকে উদ্ধার করা সিমসমূহ, অস্বাভাবিক সময়ব্যাপী কথা বলার সিমগুলো এবং বিভিন্ন তথ্যদাতার কাছ থেকে অবৈধ সিম বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সিম বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) জিয়া আহমেদ বলেন, ভিস্যাটের সঙ্গে অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রমের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ থাকায় বিটিআরসি থেকে আইএসপি লাইসেন্সধারীদের ভিস্যাট ব্যবহার অনুমোদন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। নতুন করে ভিস্যাটের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে নিরম্নৎসাহিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৬টি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে আরও ৩৪টি ভিস্যাট লাইসেন্স বাতিলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। ইন্টারন্যাশনাল লং ডিমট্যান্স টেলিকম সার্ভিসেস (আইএলডিটিএস) ২০০৭ নীতিমালা সংশোধন ও বিভিন্ন লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে। এই নীতিমালা সময়োপযোগী না হওয়ায় নীতিমালা সংশোধনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে প্রসত্মাব করা হয়। পরে নীতিমালাটি সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে নীতিমালাটি চূড়ানত্ম অনুমোদনের অপোয় আছে। নতুন নীতিমালা অনুমোদনসাপে েবৈধ পথে আনত্মর্জাতিক কল আদান-প্রদানের জন্য আরও অধিক সংখ্যক ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডবিস্নউ) ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) অপারেটরের লাইসেন্স প্রদান করা হলে অবৈধ কলগুলো বৈধ পথে আসবে। এতে জাতীয় রাজস্ব আয় বাড়বে। অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রম বন্ধের জন্য ইতোমধ্যে ৩৩টি আইপি টেলিফোন অপারেটরকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.