ক্রিকেটারও শামিল জনতার স্রোতে by রাজীব হাসান

নড়াইলের দস্যিপনার গন্ধ এখনো যে গা থেকে মুছে যায়নি, প্রমাণ দিতে দেরি করলেন না। সবার আগে ঝাঁপিয়ে ‘মঞ্চে’ উঠলেন মাশরাফি বিন মুর্তজাই। বাড়িয়ে দেওয়া হাত টেনে ধরে মঞ্চে তুললেন আশরাফুল, রাজ্জাকদের।
উঠে এলেন নাসির, ইলিয়াস সানি। নেতা তিনি, কাপ্তান! সবাই ঠিকমতো ‘জাহাজে’ উঠে পড়েছে নিশ্চিত হওয়ার পরই সবার শেষে উঠে এলেন মুশফিকুর রহিম। উঠে এলেন কজন বোর্ডকর্তা, সভাপতি নাজমুল হাসানের নেতৃত্বে।
সার বেঁধে দাঁড়িয়ে সবাই ধরলেন একে অন্যের হাত। উঁচিয়ে ধরা হলো সেই হাতের শিকল— একতার প্রতীক। যেন জানিয়ে দেওয়া হলো, সাধারণ মানুষের এই ঐক্যকে সশ্রদ্ধ স্যালুট। এই মুঠোবন্দী হাত সংহতিরও প্রতীক। কেউ মুখে বা মাইক্রোফোনে কিছুই বললেন না। কিন্তু না-বলেও যেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরা বলে গেলেন আসল কথাটি—এই আন্দোলনের সঙ্গে আমরা আছি, থাকব। অনুচ্চারে কিন্তু তার পরও প্রবল গর্জনে যেন ক্রিকেটাররাও জানিয়ে দিলেন—বায়ান্ন, উনসত্তর আর একাত্তরের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই! দেশের তারকা ক্রিকেটারদের সাধারণ প্রতিবাদকারীর মিছিলে শামিল হওয়ার অভূতপূর্ব এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকল কালকের শাহবাগ! দেশের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি অনন্য নজির স্থাপন করলেন বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। দেশ, জাতীয় পতাকার আবেগ তাঁদের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এখন সবচেয়ে যোগ্য বাহক এঁরাই। ক্রিকেট দলই এখন আমাদের হাসি-কান্নার উৎসস্থল। ক্রিকেটই পারে সংকীর্ণ দলাদলি ভুলিয়ে পুরো দেশকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসতে। কিন্তু এবার ক্রিকেট নয়, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মঞ্চে সাধারণ মানুষকে নিয়ে এল এক কাতারে। ক্রিকেটাররাও তাতে যুক্ত হলেন। ওপরে, অন্যলোক থেকে এই আবেগঘন দৃশ্য নিশ্চয়ই দেখেছেন শহীদ জুয়েল। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটের ময়দান ছেড়ে নেমে পড়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধে। ব্যাটের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিল স্টেনগান, বলের বদলে গ্রেনেড। প্রাণ দিয়ে স্বাধীন করেছেন দেশ।
পরে ফোনে ক্রিকেটাররা জানিয়েছেন, নৈতিক তাগিদ থেকেই এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বর্তমান ক্রিকেটারদের পাশাপাশি এসেছিলেন ’৯৭-এ বাংলাদেশকে এমনই এক আবেগের সমুদ্র বানিয়ে ফেলা সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান। এসেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সফলতম অধিনায়কদের একজন হাবিবুল বাশার। হাবিবুল যেমন বললেন, ‘পত্রিকায়-টিভিতে এই আন্দোলনের খবর দেখে প্রতিদিনই যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছি। আমার স্ত্রী তো তিন দিন থেকেই নিয়ে যেতে বলছে। আজ বোর্ডে একটা সভা ছিল। সবাই একসঙ্গে হয়েছিলাম। সেই সুযোগে এলাম একসঙ্গে একই বাসে। সশরীরে না থাকলেও এত দিন মানসিকভাবে তো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলামই। ক্রিকেটাররা তো আলাদা কিছু না, দেশেরই অংশ। দেশ আছে বলেই আমরা খেলতে পারি।’
আন্দোলনকারীদের স্যালুট জানিয়ে মাশরাফি বলেছেন, ‘একাত্তরের পর এত বড় অরাজনৈতিক আন্দোলন আর হয়েছে কি না আমার জানা নেই। দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই। আমরা তো দেশের জন্যই খেলি। আজ দেশ না থাকলে আমি মাশরাফিকে কেই-বা চিনত। সমাবেশে গিয়ে আমি দেখেছি, একেবারে শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের সবাই আছেন। আমাদের দেশে সমস্যার শেষ নেই। কিন্তু আমি সব সময়ই এই দেশকে নিয়ে আশাবাদী।’
ষষ্ঠ দিনের আন্দোলনে প্রেরণার বাড়তি জ্বালানির জোগানটাও দিয়ে গেলেন ক্রিকেটাররা। টানা ছয় দিন বিরামহীনভাবে ঢাকার হূৎপিণ্ড দখল করে রেখে চলেছে এই আন্দোলন। কাল তপ্ত দুপুরে আন্দোলনকারীদের প্রত্যেককে মনে হচ্ছিল একেকজন কৃষক, আশার আর প্রতিবাদের বীজ বুনছেন যাঁরা। দরদর করে ঘামছেন। সেই ঘাম শুষে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে মাথায় বেঁধে রাখা লাল-সবুজ। তারুণ্যের প্রবল উচ্ছ্বাসে আড়ালে চলে গেলেও ক্লান্তির রেখা উঁকি দিচ্ছিল পশ্চিম দিগন্তে ঢলে যাওয়া সূর্যের মতো। ক্রিকেটারদের উপস্থিতি এক ঝলক টাটকা বাতাস এনে দিয়েছে দ্রোহের বনাঞ্চল হয়ে ওঠা শাহবাগে। আর সেই ক্রিকেটারদের বরণ করে নিয়েছেন খোদ ‘বঙ্গবন্ধু’!
প্রচণ্ড জ্যামের কারণে ক্রিকেটারদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অপূর্ব নামের ছয়-সাত বছর বয়সী এক ছেলের হাতে তুলে দেওয়া হয় মাইক্রোফোন। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া সেই চিরচেনা হাতাকাটা কালো কোট। শুধু বঙ্গবন্ধুর বেশভূষাই নয়; অপূর্ব সবাইকে আরও চমকে দিল সাতই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পুরোটাই অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়ে। সেই একই বাচনভঙ্গি, তর্জনী উঁচিয়ে দুঃশাসকদের রক্তচক্ষুকে পাল্টা জবাব দেওয়া। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বলতেই ‘প্রজন্ম চত্বরে’ মুশফিকদের আগমন। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে যেন শোরগোল পড়ে গেল। পথে বসেই আন্দোলন চলছে। কোনো মঞ্চ নেই। লেখার শুরুতে যেটাকে ‘মঞ্চ’ বলা হয়েছে, সেটি আসলে তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে বানিয়ে ফেলা। টিভি ক্যামেরার জন্য বানানো পাশাপাশি দুটি মাচাকেই মঞ্চ বানিয়ে ফেলা হলো। তাতে জায়গা হলো খুব কম জনেরই। সেই মঞ্চে উঠতে না পারলেও নিচে ছিলেন মমিনুল, আবুল হাসান, রুবেল, নাজমুলরা। আগের দিন সপরিবারে এসেছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। কাল বিপিএলের দল দুরন্ত রাজশাহী আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের দলে কোনো পাকিস্তানি ক্রিকেটারকে তারা নেবে না। জানা গেছে, জাতীয় দলের প্রায় সবাই-ই এসেছিলেন কাল। তবে অনেকেরই চোখ যে দুজনকে খুব করে খুঁজল, সেই সাকিব আর তামিম আসেননি।
মুশফিক-আশরাফুলদের হাতে এদিন ব্যাট ছিল না। মাশরাফি-রাজ্জাকের হাতে এদিন বলও ছিল না। সব সময় লড়াইটা তো ২২ গজি উইকেটে হয় না। সেই লড়াইয়ের জন্যও তাঁরা প্রস্তুত। শাহবাগের তপ্ত রোদ্দুরে জনতার গর্জনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁদের মুষ্টিবদ্ধ হাত যখন উত্তোলিত হলো, গর্জন করে উঠল সমবেত হাজার হাজার মানুষ—জয় বাংলা!

No comments

Powered by Blogger.