বাংলাদেশের নানান ভাষাদেশে চালু আছে অনেক ভাষা এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন- ফারসি by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

ফারসি ভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই ফারসি ভাষার প্রচলন ছিল। ইরান থেকে আসা সুফি-দরবেশ, ব্যবসায়ী, সৈনিক ও রাজন্যরা এখানে ফারসি নিয়ে আসেন।
বাংলায় ইসলাম প্রসারের পেছনে এদের উদ্যম বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামের পিছু ধাওয়া করে এই জনপদে আসে আরবি ও ফারসি। ১২০৩ সালে বখতিয়ার খলজির নদীয়া-বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম যুগের শুরু হয়। এর পর থেকে যেখানেই মুসলমানদের বসতি হয়েছে, সেখানেই মসজিদ, মক্তব ও মাদ্রাসার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা।
মনে রাখতে হবে, ৬০০ বছরের (১২০৩-১৮৩৭) বেশি সময় ধরে ফারসি ছিল বাংলার রাষ্ট্রভাষা। এই দীর্ঘ সময়ে হাজার হাজার ফারসি গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসব সাহিত্যকর্ম পাণ্ডুলিপি বা ছাপা বই হিসেবে পৃথিবীর নানা গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
মধ্যযুগে প্রধানত ফারসি ও বাংলা ভাষার সমন্বয়ে মুসলমান লেখকদের মধ্যে ‘দোভাষী সাহিত্য’ বলে একটি বিশেষ রীতির প্রসার ঘটে। একে অবশ্য দোভাষী না বলে ‘মিশ্র সাহিত্য’ বলাটাই সংগত।
উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন ও আধুনিক গ্রন্থাগার স্থাপিত হওয়ায় ফারসিচর্চা প্রসার লাভ করে। মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু রাজা-মহারাজারা ফারসি সাহিত্যচর্চায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বাংলার রেনেসাঁর প্রধান পুরুষ রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ফারসি ভাষায় তোহফাতুল মুওয়াহিদীন গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৩৭ সালের ২০ নভেম্বর কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট একটি অধ্যাদেশ (নং ২৯, ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) জারির মাধ্যমে অফিস-আদালত তথা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ফারসির ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে ফারসির চর্চা স্তিমিত হয়ে আসে।
বাংলাদেশে এখন মূলত বিদ্যায়তনিক পরিসরেই ফারসি চর্চিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে যে ১২টি বিভাগ খোলা হয়েছিল, ‘ফারসি ও উর্দু বিভাগ’ তার একটি। ২০০৬ সালে ‘ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ’ নামে স্বতন্ত্র বিভাগ চালু হয়। এর বাইরে ফারসির চর্চা অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর ফারসির ব্যাপক প্রভাব কমজোর হয়নি। ফারসিচর্চার ৭০০ বছরে বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি শব্দ ও ভাষাভঙ্গি প্রবেশ করেছে। আমাদের সাহিত্যে অন্তত ১০ হাজার ফারসি শব্দ নানা সময়ে ব্যবহূত হয়েছে। অতি পরিচিত বাংলা শব্দ ও বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে ফারসির প্রভাব। যেমন, ‘আবহাওয়া এখন বেশি গরম আছে’—এ বাংলা বাক্যটি শাব্দিক ও গাঠনিক দুই দিক থেকেই ‘আবহাওয়া আকনুন বিশ গার্ম আছত্’ এই ফারসি বাক্যের অনুরূপ।
ফারসি ভাষার বিখ্যাত মরমি কবি জালালউদ্দিন রুমী তাঁর মসনবীতে ফারসি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যা বলার ফারসিতে বলো, আরবি যদিও বেহ্তর—প্রেম নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেবে সকল ভাষার ভেতর।’

No comments

Powered by Blogger.