বিষণ্নতার সঙ্গে ভিনসেন্টের লড়াই by আরিফুল ইসলাম

দরজায় টোকা দিতেই তা খুলে স্বাগত জানালেন হাসিমুখে। দরজার মুখেই কিটব্যাগ, বুট, ব্যাট, গ্লাভস ছড়ানো-ছিটানো। আরেকজনকে পাওয়া গেল রুমে, ট্রাভিস বার্ট।
প্রায় অপরিচিত একজনের সামনেই খুনসুটিতে মেতে উঠলেন বার্টের সঙ্গে। দরজা খোলা পেয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন রিকি ওয়েসেলস, ড্যানিয়েল হ্যারিসরা। তাঁদের সঙ্গেও খুনসুটি চলল। এই লু ভিনসেন্টকে দেখে মনে পড়ল হাবিবুল বাশারের কথা।
ভিনসেন্ট বিষণ্নতায় ভুগেছেন জানার পর যেন আকাশ থেকে পড়েছিলেন হাবিবুল। বিপিএল চলাকালীন এক দিন মিরপুরের প্রেসবক্সে বাংলাদেশ নির্বাচক ও সাবেক অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘ভিনসেন্ট কিন্তু খুব মজার ছেলে।’ স্বগতোক্তির মতো হাবিবুলের কথাটাই মনে পড়ছিল হোটেল রূপসী বাংলায় নিজ কক্ষে ভিনসেন্টকে দেখে, ‘এমন একজন ছেলের বিষণ্নতা হয় কেমন করে!’
কিন্তু ভিনসেন্ট বিষণ্নতায় ভুগেছেন এবং এখনো পুরোপুরি মুক্তি পাননি, এটাই বাস্তবতা। মার্কাস ট্রেসকোথিকের মতো বড় তারকা নন, সে সময় জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন বলেই হয়তো ততটা আলোচিত হয়নি ভিনসেন্টের ব্যাপারটা, তবে সাবেক ইংলিশ ওপেনারের চেয়ে কোনো অংশেই কম ভুগতে হয়নি কিউই ব্যাটসম্যানকে। ধরনটা যদিও খানিকটা আলাদা।
ভিনসেন্টের বিষণ্নতা রোগের শুরু ২০০৭ সালে। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেননি। ২০০১ সালে ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-লি-ওয়ার্নদের বিপক্ষে পার্থে টেস্টে অভিষেকেই সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরি। পরের টেস্টেই বাংলাদেশের বিপক্ষে শূন্য। এই শুরুটাই ভিনসেন্টের পুরো ক্যারিয়ারের প্রতীকী। উত্থান-পতনে ভরা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ছয় বছর দলে আসা-যাওয়াই করতে হয়েছে। ২০০৭ সালের শেষ দিকে আরেক দফা বাদ পড়ার পর পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। পারিবারিক জীবনেও চলছিল অশান্তি, স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা চলছিল। সব মিলিয়েই শুরু জীবনের অন্ধকার ওই অধ্যায়।
দুঃসহ সময়ের শুরুটার কথা হাসতে হাসতেই বললেন ভিনসেন্ট, ‘নিউজিল্যান্ডের বাড়িতে একদিন স্ত্রী-মেয়ের সঙ্গে বসে ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো আমি নড়তে পারছি না, চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। এভাবে মনে হচ্ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। স্ত্রী-মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেকে একদম শূন্য শূন্য মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল মরে যেতে।’ সেই শুরু, এরপর বিষন্নতা ভিনসেন্টকে আঁকড়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে, ‘কোনো কোনো দিন ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে আমার উদ্ভ্রান্তের মতো লেগেছে। অনেক নেতিবাচক ভাবনা একসঙ্গে মাথায় ভিড় করেছে...বিছানার চাদর টেনে তুলে ফেলেছি, চেয়ার-টেবিল, সামনে যা পড়েছে ছুড়ে ফেলেছি।’
সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগতে শুরু করেছিল ক্রিকেট খেলাটাই। ২০০৮ সালে হুট করেই জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে নাম লেখালেন আইসিএলে। পরের বছর কিছুদিন কাউন্টি খেলে একেবারেই দূরে সরে গেলেন ক্রিকেট থেকে। নিউজিল্যান্ড ছেড়ে থিতু হলেন ইংল্যান্ডে। চলতে থাকল চিকিৎসাও। নিজেও অনেক পড়াশোনা করেছেন বিষণ্নতা নিয়ে, চিকিৎসকের বাতলে দেওয়া সব পথে হেঁটেছেন। জাতীয় দলে ফেরার আশায় আবার ফিরে গেছেন নিউজিল্যান্ডে। ফেরা অবশ্য হয়নি, তবে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আস্তে আস্তে ফিরে পেয়েছেন। সেই ভালোবাসার টানেই বিপিএল খেলতে এসেছেন খুলনা রয়েল বেঙ্গলসের হয়ে।
তবে ভালো করেই জানেন, ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা ‘পশু’টা জেগে উঠতে পারে আবার। নিজের জীবন থেকেই তাঁর উপলব্ধি, ‘বিষণ্নতা কখনোই পুরোপুরি ছেড়ে যায় না। লড়াইটা প্রতিনিয়ত।’ নিজেকে চাঙা রাখার জন্য নানা পথ খুঁজতে হয় তাই সব সময়ই। গত বছর যেমন বেছে নিয়েছিলেন ‘বাস-জীবন’। সংসার পেতেছিলেন পুরোনো একটা বাসে, থেকেছেন সেখানে ছয় মাস! ‘ওই সময়টা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়। বর্তমান-সাবেক অনেক ক্রিকেটার এসেছিলেন আমাকে উৎসাহ দিতে। ভিভ রিচার্ডস, ক্রিস গেইল, গ্রায়েম সোয়ান, ডোয়াইন ব্রাভো, সাইমন ক্যাটিচ...আমার ওয়েবসাইটে (whereislou.co.uk) সবার ভিডিও আছে। মুশতাক, সাকলায়েন, ইউসুফরা এসে আমার জন্য প্রার্থনা করেছে।’
সেই বাস নিয়ে ভবিষ্যতে আসতে চান বাংলাদেশে। প্রথমবার এসেই প্রেমে পড়ে গেছেন বাংলাদেশের মানুষের, ‘ট্রাফিক জ্যামটা বড় একটা সমস্যা, তার পরও আসব, কারণ বাংলাদেশের মানুষ অনেক বন্ধুত্বভাবাপন্ন। বাস নিয়ে খুলনায় চলে যাব। ওই শহরটাকে আমার ভালো লেগেছে। পাশ্চাত্যের ছোঁয়া নেই, বড় বড় শপিং মল নেই, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা নেই...। বিলাসবহুল গাড়ি, দামি জামা-কাপড়, দিন শেষে এসব কী খুব বেশি দরকার! বেঁচে থাকার মতো খাবার, মাথা গোঁজার একটু জায়গা হলেই তো হয়!’
বিষণ্নতার ছোঁয়ায় জীবনকে দেখার চোখই বদলে গেছে লু ভিনসেন্টের।

No comments

Powered by Blogger.