অনাবাসী আয় আসে না মূলধারায়, অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে শঙ্কা- প্রবাসে ওরা টাকার মেশিন শেষ by শাহ্ আলম খান

রেমিটেন্স প্রবাহের ধারাবাহিক স্ফীতিতে তুষ্ট সবাই। একে কেন্দ্র করে নীতিনির্ধারকরা মধ্যম আয়ের অর্থনীতি বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন। ব্যাংকাররা আশায় রয়েছেন বিশ্ব শ্রমবাজার থেকে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ কমিশন খাওয়ার।
আর এর মাজেজা জনসমক্ষে তুলে ধরতে অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের ভবিষ্যত সভা-সেমিনারও ভালই জমবে। এগুলোর সবই আশা এবং প্রাপ্তির খবর দেশের অর্থনীতির জন্য। তবে রেমিটেন্সকেন্দ্রিক এ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকারের’ মতোই চরম দুঃসংবাদও রয়েছে। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়েরই প্রণীত মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামোতেই (এমটিবিএফ) এই দুঃসংবাদ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব শ্রমবাজার থেকে ভবিষ্যতে অধিক পরিমাণে রেমিটেন্স অর্জনে বাংলাদেশকে বড় তিনটি ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে। এর সঙ্গে এমটিবিএফের বাইরে শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা যোগ করেছেন আরও একটি শঙ্কা।
রেমিটেন্সকেন্দ্রিক মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) সতর্কবার্তার প্রথমটিতে বলা হয়েছে, মুদ্রা বিনিময় হারের অপ্রত্যাশিত ওঠানামা কিংবা অফিসিয়াল (আন্তঃব্যাংক) ও আনঅফিসিয়াল (সমান্তরাল বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার) মুদ্রা বিনিময়হারের ব্যবধান বৃদ্ধি অস্থির করে তুলতে পারে চলমান স্থিতিশীল রেমিটেন্সকে। দ্বিতীয় সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের মোট রেমিটেন্স প্রবাহের ৬৬ শতাংশ আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যার মধ্যে ৩১.২ শতাংশই আসছে সৌদি আরব থেকে। বাকি ১৭.২ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ৯.৩ শতাংশ কুয়েত এবং অতিরিক্ত ৫.৩ শতাংশ আসে মালয়েশিয়া থেকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক কেন্দ্রীভূত শ্রমবাজার বিস্তারের প্রবণতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্ব তথা ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া এবং আফ্রিকার উন্নত দেশগুলোতে সঙ্কীর্ণ করে দিতে পারে আমাদের শ্রমবাজার। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্জিত শ্রমবাজারকেও হাতছাড়া করতে পারে।
এমটিবিএফের তৃতীয় ও শেষ সতর্কবাতায় বলা হয়েছে, বিশ্ব শ্রমবাজারে ইতোমধ্যে রফতানিকৃত শ্রমিকের একটি বৃহৎ অংশই (প্রায় ৫৩ শতাংশ) অদক্ষ। আর ১৫ শতাংশ রয়েছে আধা দক্ষ শ্রমিক। এতে ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, যেকোনও রেমিটেন্স আহরণের যে কোন উৎস দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হলে প্রথম আঘাতটি আসবে এই শ্রেণীর (অদক্ষ ও আধা দক্ষ) শ্রমিকের ওপরই। সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যহারে শ্রমিক দেশে ফেরত আসার নেপথ্য কারণও এটিই।
অপরদিকে দেশের অন্যতম বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পর্যালোচনায় এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ২০১২ সালে প্রকাশিত আঙ্কটাডের রেমিটেন্সভিত্তিক একটি প্রতিবেদনে অনাবাসী আয় মূলধারায় যুক্ত হচ্ছে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এ শঙ্কার কথা জানিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের প্রশিক্ষিত এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী অভিবাসী যারা রয়েছেন, তাদের আয়ের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির খুব একটা সংযোগ নেই। ওই বাড়তি আয়ের বাংলাদেশী অভিবাসী নাগরিকদের রেমিটেন্স দেশে আসার প্রবণতা একেবারেই নগণ্য। আবার যাদের আসে, তাদের ওই আয় খুব একটা পরিকল্পিত ব্যয়ও হয় না। এক্ষেত্রে অনাবাসী বাংলাদেশীদের আয় দেশে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে সরকার ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ে অনাবাসী অভিবাসন শব্দটি যোগ করে কিংবা পৃথক মন্ত্রণালয় খুলে এ ব্যাপারে ভবিষ্যত কর্মকা- পরিচালনা করা গেলে তাদের আয়ও দেশের অর্থনীতির মূলধারায় যুক্ত হবে।
একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. খন্দকার বজলুল হক। তাঁর মতে, সচ্ছল প্রবাসীদের অনেক কিছু করার থাকলেও তারা তা করেন না। অথচ গরিব ও অসচ্ছল প্রবাসীরাই তাদের কষ্টার্জিত রেমটেন্সে দেশে পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। বর্তমানে ছোট পদে চাকরি করেই প্রবাসীরা এ রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। ভাল ভাল পদে চাকরি করলে রেমিটেন্স ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত।
অন্যদিকে রেমিটেন্সকেন্দ্রিক ভবিষ্যত শঙ্কা দূর করতে করণীয় পরামর্শ রেখে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত জানান, ‘রেমিটেন্স প্রবাহে আমাদের মূল হাতিয়ারই হচ্ছে এই অদক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিকের আয়। এ সমস্ত প্রবাসীদের মধ্যে যারা অদক্ষ ও কম শিক্ষিত তারাই সবচেয়ে বেশি রেসিটেন্স পাঠান। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানো গেলে আয় আরও বাড়তো। এ জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নে তিনি সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে আমাদের অদক্ষদের প্রতিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
এ ব্যাপারে বেসরকারী উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন জানান, শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়াতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কোন বিকল্প নেই। এর গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি বলেন, বেসরকারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন এফবিসিসিআই এ লক্ষ্যে একটি ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করার চিন্তাভাবনা করছে। পাশাপাশি অভিবাসীদের আরও কীভাবে কাজে লাগানো যায় ও তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায় তাও গবেষণা করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও অদক্ষ শ্রমিকদের কাজের উপযোগী যথাযথ প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা দেয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একইভাবে বিদেশের নতুন বাজার ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সর্বোত্তম সমন্বয় প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যুদ্ধে বিপর্যস্ত হলেও আরব বিশ্বে এখনও বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশও এখন নতুন শ্রম বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড বিদেশ থেকে কর্মী না নিলেও সেখানে কাজের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতিক তৎপরতায় সে সব দেশে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মালদ্বীপে মাছ ধরার কাজে বাংলাদেশী কর্মীদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বৈধভাবে পাঠানো গেলে কম জনসংখ্যার দেশটিতে লাখো বাংলাদেশী কর্মীর কাজের ব্যবস্থা হবে। ওই প্রতিবেদনে বিদেশে বাংলাদেশী পুরুষ কর্মীর তুলনায় নারী কর্মীর অনুপাত নগণ্য উল্লেখ করে (মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ) বেশি করে নারী কর্মীদের পাঠানোর ওপরও জোর দেয়া হয়েছে।
শ্রমবাজারে বিদ্যমান বাস্তবতার কথা স্বীকার করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, এখনও আমাদের যে সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট, সেটি হচ্ছেÑ বেশিরভাগ শ্রমিকই অদক্ষ। যে কারণে তারা বিদেশে গিয়েও সবচেয়ে নিম্নপর্যয়েরও সবচেয়ে কম বেতনের কাজ পাচ্ছেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কিছুটা দক্ষ করে পাঠানো গেলে তারা অন্তত প্লাম্বার, কার্পেন্টারের মতো কাজ পাবেন, এতে তাদের মজুরি মূল্য যেমন বাড়বে, তেমনি দেশে রেমিটেন্স প্রবাহও বহুগুণ বাড়বে।
এ বিষয়ে করণীয় জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দক্ষ শ্রমশক্তির সরবরাহ বাড়াতে বিদেশ গমনের আগে অদক্ষ শ্রমিকদের সরকার ভাষা জ্ঞান উন্নয়নের পাশাপাশি ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ডিভাইস, পাইপ ফিটিং, বৃক্ষ রোপণ, সেলাই, সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স গ্রহণের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব হবে।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, বতর্মানে সরকারের পরিচালনায় দেশে ৩৮টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যার মাধ্যমে বছরে ৬৫ হাজার নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। শীঘ্রই আরও ৩৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে, এটি শেষ হলে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হবে। মন্ত্রী জানান, এ ছাড়াও সরকার শ্রমবাজার সম্প্রসারণের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মতো নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে প্রবাসী উদ্যোগে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা যাতে প্রবাসীরাই উপকৃত হবে সবচেয়ে বেশি।

No comments

Powered by Blogger.