মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নের উত্তাল দিনগুলো by মোহাম্মদ আফজাল হোসেন খোকা

৭ মার্চ বহুল প্রচারিত "দৈনিক জনকণ্ঠ" পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠার কলাম -৫ এ প্রকাশিত "৭ মার্চের ভাষণ পাকিস্তানী এক মেজরের দৃষ্টিতে" সংবাদ প্রতিবেদনটি পাঠ করে আবেগে আপ্লুত হয়েছি।
সেই সঙ্গে ফিরে গেছি স্মৃতির দরজা দিয়ে আমার জীবনের সেই যৌবনের ভরপুর উত্তেজনাপূর্ণ ঐতিহাসিক স্বাধীনতা যুদ্ধের ঊষালগ্নের উত্তাল দিনগুলোতে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একজন 'পাবলিক সার্জেন্ট' হওয়া সত্ত্বেও ২৭ বছরের এক নওজওয়ান 'আমিও' সে সময় সামিল হয়ে যেতাম জনতার সঙ্গে মিটিং-মিছিলে, যা থেকে উৎসারিত হতো দৃপ্ত শপথপূর্ণ স্লোগান "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার নেতা-আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব।" যে সংস্থাটিতে আমি চাকরিরত ছিলাম সেটির সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা (এপিআরও) পদে আসীন থাকার ফলে আমার উর্ধতন কর্মকর্তারা আমাকে মিটিং-মিছিলসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন; যাতে খবরাখবর নিয়মিত পাওয়া যায়। আমি মধ্যষাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকার পরও ঐ সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রনেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। যাদের মাঝে বেশ কয়েকজন আমার সতীর্থ-বন্ধু ছিলেন।

দুই.
মেজর সিদ্দিক সালিক ছিলেন সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের প্রেস লিয়াজোঁ অফিসার। সেনাবাহিনীতে যোগদানের পূর্বে তিনি ছিলেন প্রভাষক ও সাংবাদিক। পেশাগত দায়িত্ব পালন উপলক্ষে প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সংস্থার অফিসে তাঁর যাতায়াত ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি এদেশে পোস্টেড ছিলেন। ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তিনি যুদ্ধবন্দী হিসেবে প্রথমে ভারতে এবং সিমলা চুক্তির পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৭ সালে তাঁর "উইটনেস টু সারেন্ডার" নামক আত্মজীবনিমূলক যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, সম্ভবত সেটিই ছিল কোন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার প্রথম লেখা_ যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন অত্যন্ত নিকট থেকে।

তিন.
আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি দৈনিক জনকণ্ঠকে এ জন্য যে, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তারা "৭ মার্চের ভাষণ পাকিস্তানী এক মেজরের দৃষ্টিতে" ক্যাপশনের মাধ্যমে প্রকাশ করে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সঙ্গে প্রতিবেদক আলোচ্য প্রতিবেদনটি এত চমৎকার ভাষায় লিখেছেন যে, এরপর সিদ্দিক সালিকের লেখা সেই ইংরেজী লাইনগুলো উদ্ধৃত করার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এ জন্য বাসস এবং প্রতিবেদককে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা। তবে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যারা বর্তমানে অকারণ 'বাহাসে' লিপ্ত এই সুযোগে তাঁদের সদয় অবগতির জন্য নিবেদন করে বলতে চাই যে, দয়া করে মেজর সালিকের আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠ করলেই জানতে পারবেন ২৫-২৬ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন।

চার.
প্রিয় পাঠক ভাইবোনেরা, আসুন সিদ্দিক সালিকের ভাষাতেই তা শোনা যাক "When the first shot had been fired, `the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Radio Pakistan. In what must have been and sounded like, a pre-recorded message, Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People`s Republic of Bangladesh" (Witness to Surrender, page-75)। আবার এই একই পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন "This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved." এরই পাশাপাশি যারা বলে থাকেন যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আলাপ-আলোচনার প্রহসনের মাধ্যমে কালক্ষেণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত যে সৈন্য আনয়ন করছিলেন ক্র্যাক ডাউনের জন্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা অনুধাবন করতে পারেননি। তাদের সদয় অবগতির জন্য আবারও সিদ্দিক সালিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি; "On Mujib`s instructions, Colonel Osmani also established contact with the Bengali police, the East Pakistan Rifles and East Bengal Battalions to co-ordinate their action on a given date and time. The military team of the Awami League high command met regularly. Some serving Bengali officers also attended these meetings." (Witness to Surrender, page-58)।

পাঁচ
এ পর্যায়ে এসে আমি অপর একটি দলিল থেকেও উদ্ধৃতি দিচ্ছি, Pakistan was thrust into civil war today when Sheikh Mujibur Rahman proclaimed the East wing of the two-part country to be "the sovereign independent People`s Republic of Bangladesh." Fighting is reported heavy in Dacca and other Eastern cities where 10,000 man paramilitary East Pakistan Rifles has joined police and private citizens in conflict with an estimated 23,000 West Pakistani regular army troops. উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২৫-২৬ মার্চ মধ্যরাতের পর পরই স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার প্রেৰাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Defence Intelligence Agency_26 March1971 তারিখের DIA Spot Reportটির ১নং অনুচ্ছেদ আমি হুবহু উপস্থাপন করলাম। সম্প্রতি এটি Declassified করেছে ঐ সংস্থা।

ছয়.
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, উপরে যে ইংরেজী উদ্ধৃতিগুলো আমি দিয়েছি তা থেকে কি নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয় না যে, বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি বরং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল রূপকারও তিনি। অতএব, আমি মনে করি যারা সবকিছু জেনেশুনেও স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের রূপকার সম্পর্কে অহেতুক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে চলেছেন তাদের প্রতি সমুচিত জবাব হবে আমরা এ বিষয়ে যে যা জানি তা আমাদের সন্তানতুল্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে নির্দ্বিধায় তুলে ধরা। যাতে তারা জানতে পারে সঠিক ইতিহাস।

লেখক : পরিচালক (অব) পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড।

No comments

Powered by Blogger.