সময় এসেছে নারীর কর্তৃত্ব গ্রহণের by ফারহানা ইসলাম জয়া

দামিনী তো (জ্যোতি সিং পান্ডে) মরে গিয়ে বেঁচে গেল। কিন্তু কাপাসিয়ার ধর্ষিত মেয়েটি? প্রথমবার সে ধর্ষিত হলো স্থানীয় সংসদ সদস্যের কথিত এপিএস কাজল মোল্লার কাছে। বেঁচে থাকলে, যে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে, তাতে সে ধর্ষিত হবে দ্বিতীয়বার।
এর পর যত দিন সে বেঁচে থাকবে তত দিনই তাকে ধর্ষিত হতে হবে- এই অমোঘ মূল্যবান (!) পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বারা। তাহলে কি নারীর জন্য আমাদের মেনে নিতে হবে মধ্যযুগের ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব 'অ্যানাটমি ইজ ডেসটিনি?'
কাপাসিয়ার মেয়েটির দুই হাত কব্জি পর্যন্ত গরম তেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। থেঁতলে দেওয়া হয়েছে তার শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে বাথরুমে আটকে রাখা হয়েছে এক সপ্তাহ। সেখানে কাজল মোল্লা তাকে ধর্ষণ করেছে। এর পর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে ঝোপের ভেতর। মোল্লার ক্যাডারদের ভয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও মেয়েটিকে হাসপাতালে নিতে পারেননি তার দিনমজুর বাবা। শরীরে অগণন নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে অবশেষে মেয়েটি যখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছায় তখন কাজলের ২০ থেকে ৩০ জন ক্যাডার হাসপাতাল থেকে মাসহ তাকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এর পর মোল্লা ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী 'কালের কণ্ঠে' প্রকাশিত 'পশু দম্পতি' শিরোনামের সংবাদটিকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। সংবাদ সম্মেলনে মেয়েটিকে দিয়ে জোর করে মিথ্যা বলিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁরা মেয়ে ও তার বাবাকে ক্রমাগত প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকেন। মেয়েটির স্বাক্ষর নিয়ে তাঁরা পছন্দমতো বক্তব্য লিখে নেন। বাবাকে বাধ্য করা হয় ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা বলে ঘোষণা দিতে। সংবাদ সম্মেলন চলাকালে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ঘিরে রাখে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের শতাধিক ক্যাডার। স্থানীয় থানা পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকাও ছিল এ ক্ষেত্রে দলীয় ক্যাডারদের মতোই।
কাপাসিয়ার মেয়েটির ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রায় সব ঘটনা একসঙ্গে ঘটেছে। প্রতিবেদনটি পড়ার পর স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়! স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, যে সমাজে আমরা বাস করছি এটা কি মানুষের সমাজ? মাত্র কয়েক দিন আগে পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হাজত বাস করেছে যে তরুণ, সে জামিনে বেরিয়ে এসে শিশুটির ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। ধর্ষণ করে তাকে হত্যা করেছে। এসব আহাজারি আর বিস্ফোরণে মাঝেমধ্যেই কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। সংবাদপত্রের পাতা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ক্রিন ভেসে যায় আবেগের প্লাবনে। কয়েক দিন আমরা বিলাপ করি। এর পর ভুলে গিয়ে আবার যে যার কাজে মগ্ন হয়ে যাই।
হাজার বছর ধরে যেখানে সংস্কৃতিতে নারীর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সমাজের সবচেয়ে নিচের পাদানিতে, যেখানে শুধু আইন করে রাতারাতি নারীর সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন অসম্ভব। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দু-চারটে শহুরে প্রতিবাদ! পুরুষতন্ত্র তার থোড়াই কেয়ার করে! আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের অধিকার সমান। কিন্তু এ সাম্যের বিধান শুধু সংবিধানের সৌন্দর্যই বাড়িয়েছে আর কোনো কাজ হয়নি। বাস্তবে নারীর জন্য প্রয়োগ হয় মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়াশীল বিধান। কোনো এলাকায় একা এক তরুণী থাকলে ওই এলাকার সব পুরুষের কাম-বাসনা তাকে ঘিরে জ্বলতে থাকে। পরিবারে নারী? আধুনিক পরিবার দাঁড়িয়ে আছে নারীর প্রকাশ্য বা গোপন গার্হস্থ্য দাসত্বের ওপর। সেই কবে এঙ্গেলস বলেছিলেন, 'পরিবারের মধ্যে স্বামী হচ্ছে বুর্জোয়া, স্ত্রী প্রলেতারিয়েত।' অবস্থা এতটুকু বদলেছে বলে আমার মনে হয় না। নারী! সে কর্মজীবী হলেও প্রলেতারিয়েতই! প্রভু স্বামীই!
হলিউড, বলিউড, ঢালিউড, বিল বোর্ড, বিজ্ঞাপন, রিয়ালিটি শোসহ মিডিয়ার প্রায় সব মাধ্যমে বাস্তব নারীর ভাবমূর্তি আড়াল করে প্রদর্শিত হচ্ছে নারীর যৌনাবেদন। এ যৌনসর্বস্ববাদী মিডিয়ার আগ্রাসী ইচ্ছার শিকার নারী। আমরা যত দিন না মানব, আমাদের বিদ্যমান সমাজ সংস্কৃতিতেই নারীর জন্য যৌন নিপীড়নের হুমকি রয়ে গেছে, তত দিন সংকট অবসানের প্রাথমিক স্তরেও পৌঁছাতে পারব না। বাজার অর্থনীতির এ জমজমাট সময়ে ভোগ্য পণ্যের বিপণনে নারীর যৌন আবেদনকে অত্যন্ত কৌশলে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বীকার করতেই হবে- এটা পুঁজিবাদের অভিশাপ। কেননা পুঁজিবাদ, সব কিছুই তার কাছে বাণিজ্য। পুঁজিবাদ সব কিছু নির্ধারণ করে বিপণন যোগ্যতার নিরিখে। ফলে নীতি! ঔচিত্য বোধ! এবং সংস্কৃতি! সব কিছু তছনছ করে দিয়ে যে সর্বনাশের খেলায় সে মেতেছে তার প্রথম শিকার নারী।
আমাদের যা করতে হবে তা হলো- ধর্ষণ ও যৌনতা প্রসঙ্গে নীরবতা ভাঙতে হবে। যেহেতু আমরা নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার করেছি, তাই এ সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটিকে আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। ফিরে আসি, কাপাসিয়ার ঘটনায়। কাপাসিয়ার সংসদ সদস্য বাঙালির প্রাণের মানুষ তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। সঙ্গত কারণেই তাঁর কাছে যে দাবি এবং প্রত্যাশা আমাদের ছিল তিনি তা পূরণ করেননি। ১৯৯৯ সালে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে প্রকাশ্যে হত্যা করেছিলেন জেসিকা নামের এক নারীকে। ছয় বছর ধরে বিচারকাজ শেষে খুনিরা সবাই বেকসুর খালাস পেলে প্রায় সংবাদপত্রে শিরোনাম ছিল No one killed jesica। কাপাসিয়ার মেয়েটির ক্ষেত্রেও যেন আমাদের পড়তে না হয় No one raped...।
ধর্ষণ রোধে বাংলাদেশে কঠিন আইন আছে। সেই আইন বাস্তবায়নে বড় বাধা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। ধর্ষণে সব সময়ে ভিকটিমকেই আমরা কমপক্ষে আধডজন দোষে দূষতে থাকি। প্রতিরোধের বদলে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিই। এতে সংকুচিত হয় নারীর মৌলিক মানবাধিকার।
গত সপ্তাহে ইন্টারনেটে দেখা গেল, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন মুনিরকা বাসস্টপেজ থেকে সন্ধ্যায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রদীপ হাতে মিছিলে যোগ দেয়। ওই বাসস্টপেজ থেকেই দামিনীকে (জ্যোতি) গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাসে তুলে নেওয়া হয়েছিল। নতুন প্রজন্মের স্লোগান ছিল, 'এই রাত, এই আকাশ, সব কিছুর ওপর আমাদের সমান অধিকার আছে। ভয় দেখিয়ে সেই আকাশ, সেই রাতকে ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না।' তারা কণ্ঠে সর্বোচ্চ পর্দায় বলেছে, 'সারি রাত হামারি হ্যায়'। বাংলাদেশের নারীদের কণ্ঠেও সেই দাবিরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি- 'এ রাতের আকাশ আমারও। এই রাতে আমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি। যা ইচ্ছা বলতে পারি। এবং সেটা নিরাপদে বলতে চাই।'
'সারি রাত হামারি হ্যায়' ও 'হোল নাইট ইজ মাইন' স্লোগানে যখন দিল্লি থেকে নিউ ইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ার মুখর, তখন ভার্জিনিয়া উলফের কথা মনে পড়ে গেল। ভার্জিনিয়া বলেছিলেন, 'সিসিফাসের মতো নারীও মেনে নিয়েছে তার জীবনের নিরর্থকতা। কেননা, তার শরীরের ওপরই তার কোনো অধিকার নেই।' ২৪ জানুয়ারির কালের কণ্ঠে দেখতে পাই, মায়ের কাছে অপদস্থ হয়ে মেয়েকে ধর্ষণ। বাগেরহাটের শরণখোলায় নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নেতা। ধর্ষণকারীর হুমকির মুখে অদক্ষ, অপেশাদারি হাতে মেয়েটির গর্ভপাতের চেষ্টা করা হয়। গর্ভপাতের দেড় মাসেও রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় কিশোরীটির জীবন এখন সংকটাপন্ন। মেয়েটি এতই দরিদ্র যে হাসপাতালে পথ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও তার নেই। ২৫ জানুয়ারির কালের কণ্ঠে দেখতে পাই, মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে ১৮ বছরের এক পোশাক শ্রমিক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। চলন্ত বাসে পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে বাংলাদেশের ধর্ষকরা কি বুঝিয়ে দিতে চাইছে- দিল্লির চেয়ে কোনো কারণেই তারা ধর্ষণে পিছিয়ে থাকতে চায় না? ২৭ জানুয়ারির কালের কণ্ঠ বলছে, গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চন্দন কুমারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দেশে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তার সবই পত্রিকায় আসে না। আরো কম ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
বাংলাদেশের আইনেও তাই হওয়া উচিত। যত দিন মনুষ্যসমাজ টিকে থাকবে, ধর্ষণও থাকবে। কেননা জন্মগতভাবেই পুরুষ পলিগ্যামাস। আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত করা। জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে নারীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে, সমান সম্মান ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারে। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে নারীরা সুরক্ষিত ও সম্মানিত।
কাজেই নারীকে মুক্ত হতে হলে ইন্দ্র, জিউস ও মানিক- এদের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হবে। কেবল তখনই রাতটা নারীর হয়ে উঠবে। পুরুষ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্তৃত্ব। এখন নারীর সময় এসেছে কর্তৃত্ব গ্রহণ করার, সেটা দিন ও রাতের দুইয়েরই। পুরুষ শব্দের সমান অর্থবহন উচ্চারণে, পুরুষের সমাজ কর্তৃত্বে নারী যেন বলতে পারে, 'সারি রাত হামারি হ্যায়'।
লেখক : পরিচালক কিংবদন্তি মিডিয়া, Joya.Joybangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.