ইউআইএসসির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন by ইয়াসমীন রীমা

মাগুরা জেলার সদর উপজেলার ৪নং বগিয়া ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামের যুবক রফিকুল ইসলাম টিটু বলছিলেন “লেখাপাড়ায় বেশিদূর এগুতে পারিনি। সংসারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য ঢাকায় একটি ব্যক্তিমালিকাধীন ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নিতে হয়।
মা, অসুস্থ বাবা, ছোটভাই নিয়ে আমার আয়ের মধ্য দিয়ে সংসার চলছিল। ঢাকায় একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থতা নিয়ে গ্রামে ফিরে আসি। দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থাকায় চাকরিটি হারাই। ভারাক্রান্ত মনে কর্মের সন্ধান করতে থাকি। কর্মের সন্ধানের প্রয়োজনে নাগরিক সনদ সংগ্রহের জন্য নিজ গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসে পরিচয় উদ্যোক্তার সঙ্গে। তিনি ব্যবসায় নিজকে নিয়োজিত করার পরামর্শ দেন। মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে এ কেন্দ্রে ৪০দিনের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সটি সমাপ্ত করি এবং তারই পরামর্শে একটি কম্পিউটার ক্রয় করে বগিয়া বাজারে দোকান প্রতিষ্ঠিত করি। মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যে দোকান চালু হয়ে যায়। ব্যবসায় সফলতা আসতে শুরু করে। চাকরির পিছনে এখন আমার ঘুরতে হয় না। সংসারের দায়িত্ব পালনে কোথাও কোন অসুবিধা হচ্ছে না। নির্বিঘ্নে চলছে সবকিছু। সত্যি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ।”
বরিশাল জেলার মাহিলাড়া উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের জঙ্গলপট্টি গ্রামের আবুল কালাম বলেন, ”তথ্য সেবা হেইডা আবার কি, আগে বুঝিনাই। তয় এ্যাহন দেহি এহ্যানে সব আছে। মোর পোলায় বিদাশে থায়ে। এই কেন্দ্রে আইয়া অর ছবি দেহি আর মোরা অর লগে কথা কই। মোর পোলায়ও নাকি মোগো ছবি দেখতে পায়। এত সুযোগ-সুবিধা আগে কোতায় আছেলে।”
শাহবাজপুর গ্রামের কৃষক ইসহাক হাওলাদার বলেন, ধানের ক্ষেতে পোকার আক্রমণ হয়েছে। পোকা থেকে নিষ্কৃতি পেতে কি করতে হবে এই তথ্যটি জানার জন্য যেতে হতো উপজেলা সদরে। যাতায়াত ও অন্যান্যসহ খরচ হতো প্রায় ৫০০টাকার মতো। কিন্তু বর্তমানে ইউনিয়ন ও তথ্যকেন্দ্রে এসেই স্বল্প সময়ে ও নামমাত্র খরচে জানতে পারছি। ফলে সময় ও অর্থের সাশ্রয় যেমন হয়েছে তেমনি হয়েছে কষ্ট লাঘব।
কুকরী মুকরির ডাকাতিয়া নদী ঘাটের জেলে বেল্লাল মাঝি সপ্তাহখানেকের জন্য সমুদ্রে যাত্রা করবেন। ফিশিং ট্রলারের প্রধান মাঝি হিসেবে সমুদ্রে যাওয়ার আগে আবহাওয়ার আগাম খবর জানার জন্য তথ্য কেন্দ্রে এসেছেন। বেল্লাল মাঝি বলেন, আগে দুর্যোগের শিকার হয়ে জেলেদের জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হতো। এখন তথ্য কেন্দ্র থেকে আবহাওয়ার আগাম খবর জেনে সমুদ্রে যাই। এতে জীবন ও সম্পদ দু’টির নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে ।’
ইউনিয়ন পরিষদ দেশের প্রাচীনতম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। একসময় মানুষ ইউনিয়ন পরিষদ খুব বেশি ব্যবহার করত না। কেবলমাত্র গ্রাম্য সালিশ-বিচারের কাজে ইউনিয়ন পরিষদ মাঝেমধ্যে ব্যবহৃত হতো। ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (ইউআইএসসি) এই ধারণা পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে মানুষের প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (ইউআইএসসি) থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সরকারী- বেসরকারী তথ্যসেবা গ্রহণ করছেন। আর সেবা প্রদান করে কেন্দ্রের উদ্যোক্তারা মাসে ৬ কোটি টাকারও বেশি আয় করছেন। এছাড়া বিভিন্ন সেবার পাশাপাশি দেশের ১৭০০টি ইউআইএসসিতে ইতোমধ্যে চালু হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০ হাজার গ্রাহক প্রায় ৩৫কোটি টাকা আদান-প্রদান করছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহযোগিতায় ৩০টি ইউআইএসসি থেকে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া হচ্ছে। ২০টির বেশি ইউআইএসসি থেকে কৃষক মাটি পরীক্ষা ও সারের সুপারিশ পাচ্ছেন। শতাধিক কেন্দ্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৪৫৪৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫১৬টি ইউনিয়নে ইউআইএসসি স্থাপন করা হয়েছে।
‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের (ইউআইএসসির) যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের ৫০শতাংশ নিরক্ষর, ৯৬ শতাংশ মানুষ ইংরেজী লিখতে-পড়তে-বলতে পারে না। দেশের ৫০ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, ৯৬শতাংশ বাড়িতে নেই কম্পিউটার এবং ৯০ শতাংশের বেশি নাগরিক কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে না। তৃণমূল পর্যায়ের জনগণকে জাতীয উন্নয়নের তথ্য-প্রযুক্তি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এ কারণেই দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদে ‘ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র’ (ইউআইএসসি) স্থাপন করে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে তথ্য সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (ইউআইএসসি) প্রতিষ্ঠা গ্রামীণ মানুষের তথ্য প্রাপ্তি, দারিদ্র্য বিমোচন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং এর সাফল্য অভাবনীয়।
জনগণের দোরগোড়ায় সেবা নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ইউআইএসসি থেকে কম খরচে, সরকারী- বেসরকারী ও বাণিজ্যিকভিত্তিতে সরকারী পর্যায়ে যে সমস্ত তথ্য ও সেবা দেয়া সেগুলো হলো- ৫০ প্রকারের সরকারী ফর্ম, সরকারী নোটিস, গ্যাজেট এবং বিশেষ ঘোষণা, সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের তালিকা, ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত সেবা, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন প্রভূতি সংক্রান্ত তথ্য, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য, নাগরিকত্ব সনদ, পাবলিক পরীক্ষামূলক ফল, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি তথ্য, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক প্রশাসনিক বিভাগ ও উপবিভাগের সেবার তালিকা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য। বাণিজ্যিক সেবাসমূহের মধ্যে রয়েছে- ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ই-মেইল, ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা, মোবাইল ফোন ব্যবহার, কার্ড বিক্রয় ও রিচার্জ, কম্পিউটার কম্পোজ, স্ক্যানিং, ল্যামিনেটিং ইত্যাদি, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ভাড়া, পাসপোর্ট ও ভিসার ফর্ম পূরণ, ভিডিও প্রদর্শনী (মীনা, সিসিমপুর কার্টুন, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ইত্যাদি) ডিভি লটারীর তথ্য ও ফর্ম পূরণ, উচ্চতা ও ওজন মাপা, রক্তচাপ মাপা, নেবুলাইজার ভাড়া, খবরের কাগজ পড়া, চাষের জমির মাটি পরীক্ষা, পানির আর্সেনিক পরীক্ষা, মাচ চাষে পুকুরের পানি পরীক্ষা, বাজারদর সংক্রান্ত তথ্য এবং ক্ষুন্দ্র কুটির শিল্পের জন্য অনলাইন বাজারে প্রবেশ। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে-কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এবং ভিডিও এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ । কৃষি সংন্ত্রান্ত ও শস্য বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও সেবা, ভূমি সংক্রান্ত তথ্য ও সেবা, দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্য ও সেবা যেমন সাধারণ তথ্য, দুর্যোগ পূর্বাভাস, ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সংক্রান্ত তথ্য ও সেবা যেমন নিবন্ধন, ভাতা গ্রহীতাদের ডেটাবেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ, ভাতা বিতরণ ইত্যাদি। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা যেমন-টেলিমেডিসিন, এ্যাম্বুলেন্স বুকিং, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও রিপোর্ট প্রাপ্তি প্রভৃতি। এছাড়া এতিম ও এতিমখানা সংক্রান্ত তথ্য সেবা ও সরকারী এতিমখানায় নিবন্ধীকরণ ফর্ম, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্ভে ও ডেটাবেজ, প্রতিবন্ধী ছাত্রদের বৃত্তি বিতরণ ও অন্যান্য সেবা, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ঋণগ্রহীতার নিবন্ধন, সুদ সংগ্রহ ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য সেবা, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনা, অনলাইনে প্রবাসী কল্যাণ এ্যাপ্লিকেশন জমাদান, করের কাগজপত্র ও কর জমাদান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ ও জমাদান এবং বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণের ব্যবস্থা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মসিউর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে প্রতিবছর সাত হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় এবং অন্তত ২০ হাজার মানুষ আহত ও পঙ্গু হয়। বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের এবং মফস্বলের। এসব মানুষকে বিপদকালীন সুবিধা দিতে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র থেকে জীবন বীমা কর্পোরেশনের বীমাসুবিধা চালু করা হয়েছে।” বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক নায়েব দোলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ডাক বিভাগে দুই হাজার ৭৫০টি পোস্ট অফিস থেকে ইলেকট্রনিক মানি অর্ডার চালু করছে। ডাক বিভাগের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সর্বোচ্চ এক মিনিটের মধ্যে পোস্ট অফিস থেকে অর্থ প্রেরণ ও গ্রহণ করা যাচ্ছে। শুধু ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৯৪ জন গ্রাহক এ সেবা গ্রহণ করেছেন। এ সময়ের মধ্যে মোট ২২৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আদান-প্রদান করা হয়েছে। এ সেবা দিয়ে ডাক বিভাগ ২৮কোটি ২২লাখ ৬৬হাজার টাকা রাজস্ব আয় করেছে। সাধারণত ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে অনেকেই কম্পিউটার ব্যবহারকে মনে করলেও প্রকৃত অর্থে ব্যাপারটা শুধু তা নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া মানে হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনসহ সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আধুনিক প্রযুক্তির লাগসই প্রয়োজনের একটি আধুনিক দর্শন। আর এ দর্শনের মূল বিষয় হচ্ছে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারে মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত করা। পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবন মানের উন্নয়ন ঘটানো। দেশব্যাপী প্রযুক্তির বিস্তার ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত ছাড়া এক্ষেত্রে কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন অসম্ভব। এই ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ তথ্য সেবা কেন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধকরণ তথা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইউআইএসসি হতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। ইউআইএসসির এর ফলে গ্রামীণ জনপদে রাতারাতি বিশাল পরিবর্তন না হলেও টেকসই উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন ও জনগণের ক্ষমতায়ন হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

No comments

Powered by Blogger.