অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন by ড. মিহির কুমার রায়

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত। প্রবৃদ্ধি উন্নয়নেরই একটি সূচক যার সঙ্গে সরকারের জনপ্রিয়তার প্রশ্নটি বিশেষভাবে জড়িত। এটিই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ।
এই বছরের শেষনাগাদ বর্তমান সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। তাই ক্ষমতাসীন সরকার স্বভাবতই চাইবে তাদের আমলের উন্নয়নের দিকগুলো জাতির কাছে তুলে ধরতে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে আমরা যদি স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করি তা হলে দেখা যায় যেÑজনগণের মাথাপিছু আয় বর্তমানে আগের চেয়ে শতকরা ১৩০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে, শতকরা ৬০ ভাগ দারিদ্র্য কমেছে, মাথাপিছু গড় আয়ু ৬৭ বছরে উন্নীত হয়েছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬.৩ ভাগে অবস্থান করছে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার যথাক্রমে শতকরা ৩০ ও ২৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে এবং খাদ্য উৎপাদান (চাল) বর্তমানে ৩৩.৮০ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে যা ১৯৭৩ সালে ছিল মাত্র ১০ মিলিয়ন টন। এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর জন্য ভৌত পুঁজির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, শ্রমবাজারের প্রসার, সফল অর্থনৈতিক সংস্কার, সামষ্টিক অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনা, সঠিক বাণিজ্যনীতি, তৈরি পোশাক শিল্পের বি¯তৃতি, বাণিজ্য উদারীকরণ, হিমায়িত চিংড়ির রফতানি বৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তার উন্নতি ইত্যাদিকে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অপরদিকে ম্যাক্রো-ইকোনমিতে যে সকল নেতিবাচক দিক জাতিকে পীড়া দেয় তা হলো দুর্বল অবকাঠামো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দ্্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ন ,আর্থিক খাতে দুর্নীতি ইত্যাদি। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে ওঠার মতো হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখনও ৪.৭ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে । এই বিশাল দরিদ্রগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ সঙ্কটাপন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাস করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপুষ্টি, বিশুদ্ধ পানীয়জলের স্বল্পতা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালীর অপর্যাপ্ততা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে: যেমন বয়স্ক ভাতা, দুস্থ মহিলা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, এতিম জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা হিসেবে নগদ প্রদান ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পÑআশ্রয়ন প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, ঘরে ফেরা প্রকল্প, সামাজিক বনায়ন প্রকল্প, বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প, চরজীবিকায়ন প্রকল্প, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, সামাজিক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের অবস্থার উন্নয়নের জন্য। উদ্যোগগুলো কতটা সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের ১৪টি মন্ত্রণালয়/অধিদফতর/পরিদফতর সরাসরি দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প/কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে আসছে সত্যি কিন্তু সার্বিকভাবে সেই সকল কর্মকা-ের প্রভাব দারিদ্র্যবিমোচনে কতটুকু সহায়ক হয়েছে তা সময় সময় সাংবাদিক, মিডিয়াব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজ ও সমাজকর্মীদের ভাবিয়ে তোলে। এখন সরকার স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা/ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের তেমন গুরুত্ব না দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যদেও বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়ায় পরিবেশ আরও জটিল হয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকার কাঠামো ও জনপ্রতিনিধি এমপিগণের মুখোমুখি অবস্থানে সরকারী কর্মসূচী/প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে সকল এলাকায় বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য রয়েছে সেখানে উন্নয়ন বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়ন অনেকটা ভাটা পড়ে গেছে। এর ফলে দেশের সুষম উন্নয়ন বিশেষভাবে বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি দারিদ্র্যবিমোচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে চল্ছে স্বাধীনতার পর থেকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে আমাদের আর কত বছর অপেক্ষ করতে হবে কেউ জানে না। বর্তমান অর্থবছর (২০১২-২০১৩)-এর বাজেটবরাদ্দ হলো ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেট হলো ৫৫,০০০ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির মাত্র ৫.২৮ শতাংশ। এরি মধ্যে আর্থিক বছরের পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হতে চলছে কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বরাদ্দকৃত টাকার বিপরীতে ব্যয় মোটেই আশাপ্রদ নয় প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ।
এই রকম একটা মুহূর্তে দেশে একটির পর একটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যেমন বহদ্দারহাটের বিপর্যয়, আশুলিয়ার শিল্পে আগুনে মানব বিপর্জয়ের ঘটনা, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা, রামুর সাম্প্রদায়িক ঘটনা, গ্রামীণ ব্যাংকের ঘটনা, পদ্মা সেতুর ঘটনা যার জন্য কেউই কোনভাবে প্রস্তুত ছিল না। অথচ এর দায়ভার টানতে সরকারকে যে পরিমাণ অনির্ধারিত অর্থসম্পদ ব্যয় করতে হচ্ছে তা বাজেটের ওপর অনেকটা বিষ ফোঁড়ার মতো। এতে করে সরকারের উন্নয়ন কাজ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দারিদ্র্যবিমোচন। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচেছ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক পরিবর্তন আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়ছে রেমিট্যান্স প্রাপ্তির ওপর ভর করে। আমাদের দেশে আয় বৈষম্য বেড়েই চলছে। জনগণের আয় বেড়েছে কিন্তু মূল্যস্ফীতিও লাগামছাড়া। ফলে সাধারণ জনগণ আগে যে অবস্থার মধ্যে ছিল এখনও সেই অবস্থার মধ্যেই আছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে কিন্তু কতটুকু দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে তা এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ জনগণ এর সুফল তেমনভাবে পাচ্ছে না। সুষমভাবে উন্নয়ন না করলে, আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য, দুর্নীতি,দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে না পারলে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্যবিমোচন কেবল মরিচিকা হয়ে থাকবে। তাই তৃণমূল পর্যায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেয়া বাঞ্ছনীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক,সিটি ইউনিভার্সিটি,ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.