স্মরণ শহীদ প্রকৌশলী by নজরুল ইসলাম, আবদুল কাদের ফকির

তখন ১৯৪৭ সাল। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। জানুয়ারি মাসের দিকে শেখ মুজিবুর রহমান আসেন মাদারীপুর। মুসলমান ছাত্রদের ভবিষ্যত রাজনীতি কর্মপন্থা নিয়া আলোচনা করলেন।
স্লোগান তুললেন 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।' ঐ সময় মুষ্টিমেয় কয়েকজন পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য হিসাবে ভোরে মাদারীপুর নতুন টাউনে শুকুনিয়া দীঘির পারে প্যারেড করতাম। এমনি একদিন নজরুলের সঙ্গে দেখা হয়। সে মাদারীপুর এসেছিল তার ভগ্নিপতি দানেশ মোক্তারের বাসায় বেড়াতে। তখন মাদারীপুরে মুসলমান শতকরা ১০%-এর বেশি ছিল না। তাই অল্প যে কয়জন ছিল তাদের মধ্যে খুবই সম্প্রীতি ছিল। আর তাই নজরুলের সঙ্গে হয়ত আলাপ হয়েছিল। আর নজরুল আমাদের দুই বছরের জুনিয়র। নজরুলের সঙ্গে দেখা হয় '৫০ সালের দিকে। তখন সে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। পুরনো সেই পরিচয়ের রেশ টেনে গড়ে উঠল বন্ধুত্ব।
আহসানউল্লাহ কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই সে পাকিস্তান সরকারের একটি স্কলারশিপ পায়। বিদেশে যতটা মনে পড়ে নেদারল্যান্ডসে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। তাই সে আহসানউল্লাহ কলেজের লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে বাজেট ঘাটতির ধুয়া তুলে নজরুলের স্কলারশিপ বাতিল করে দেয়। সে তখন বেকায়দায় পড়ল। একদিকে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্লাস করতে পারবে না, অন্যদিকে উচ্চশিৰার জন্য বিদেশও যাওয়া হলো না। নজরুলের বাবা যিনি ছিলেন একজন পোস্টমাস্টার তিনিও ঐ বছর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
নজরুল তখন তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে একটি চাকরি নেয়। সময়টা হবে ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে। যা হোক চাকরিতে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরেই সে রেডিও ভয়েস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। বলতে আপত্তি নেই, সংগ্রামী নজরুল সে সময় প্রাইভেট টিউশনিও করত, পগোজ স্কুলে মাস্টারিও করত। নজরুল ও তার অগ্রজ সামসুল ইসলাম সেখানে বসতেন কার্মচারী ছিল আবুল হাশেম। ছোট্ট দোকান, হাশেম সাহেব ছিলেন স্বল্পভাষী, চমৎকার ব্যবহার। আর নজরুল কাজের লোক। সে কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। অল্প দিনের মধ্যেই দোকান জমজমাট হয়ে উঠল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। ইকবাল হলে থাকি। ব্যাংক ছুটির পরে মাঝে মাঝে দোকানে যাই গল্প করার জন্য। কিন্তু নজরুল গল্পের থেকে কাজই বেশি পছন্দ করত, তাই করত। বাহনই হোক না। পরবর্তী সুযোগেই সে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরিতে ঢুকলেন। কর্মজীবনে একজন কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব কাজ ছাড়া কিছুই জানত না। ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে সে হাজেরা নজরুলের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়। শুরু হলো আর এক জীবন। ১৯৬৫ সালে বনানীতে পিডিবির ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকত আর আমরা থাকতাম তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের কোয়ার্টারে। বনানীতে থাকার সময় আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। প্রায়ই দেখা হতো। একদিন দাওয়াত দিল নিওনের জন্মদিনে। সেদিনও দেখি সে ব্যস্ত। আমাদের চুপি চুপি জানাল, এই উৎসব-আনন্দ তার ভাল লাগে না। শুধু সামাজিকতার জন্য করতে হয়। বরং এ সময়টুকু যদি কাজ করে দেশের তথা পূর্ব পাকিস্তানের কিছু উন্নতি করা যেত তবে সে খুশি হতো। সে আরও জানাল, জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ওপর বসে আছে পাকিস্তানীরা। ওদের তাড়াতে হবে আর তার জন্য চাই কাজ, উন্নতমানের কাজ। প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা তাদের (পাকিস্তানী) চেয়ে উন্নতমানের কর্মী।
দিন যায়। যা মনে পড়ে, পাকিস্তানীদের প্রতি মানুষের হিংসা-ঘৃণা দানা বেঁধে উঠল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মাল পূর্ব পাকিস্তানীদের মনে। তারই ফলশ্রুতি হিসাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আক্রমণ করল নিরীহ বাঙালীদের ওপর। ২৭ মার্চ ভোরেই লোকজন বনানী থেকে পালাতে শুরু করল। আমাদের কোয়ার্টারের সামনের অস্ত্রধারী অবাঙালী সৈনিককে গাড়িচাপা দিল একজন বাঙালী সোলজার এবং তার পরই নিয়াজ নামের মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে জনগণ এক হয় এবং তার অস্ত্র ছিনিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছিল। আর যারা হয়নি তাদের একজন ছিল নজরুল। বনানী থেকে আমি চলে গেলাম ব্যাংকের মিন্টো রোডের বাড়িতে। মে মাসের দিকে মিন্টো রোডে সে আসল একদিন। সেদিনই তার সঙ্গে শেষ দেখা।
সে আরও জানাল যে, সে শীঘ্রই আগরতলা চলে যাবে। তবে যাওয়ার আগে ঢাকার বিদ্যুত ব্যবস্থা অকেজো করে যাবে এবং করলও তাই। মালিবাগের ইলেকট্রিক সেন্টারটিতেই প্রথম আঘাত হানল তার কর্মীরা। নজরুল যাওয়ার সময় বলেছিল, দেশ স্বাধীন না করে সে আর ফিরবে না। সে আরও বলে গেল, আমি যেন ওখানেই থাকি এবং সে মাঝে মাঝে লোক পাঠালে তাদের কাজ যেন করে দিই। নিজ দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু নজরুল আর দেশে ফেরেনি। আমরা যতটা পেরেছি সাধ্যমতো স্বাধীনতার কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছি। কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছি যে, আমরা পাকিস্তানীদের চেয়ে উন্নত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত থেকে একদল ব্যাংকার এসেছিল বাংলাদেশের ব্যাংকিং প্রথা রি-অর্গানাইজ করতে। অনেক কিছু দেখে তারা বিদায়বেলা বলে গিয়েছিল, 'আমরা এসেছিলাম ব্যাংকিং শেখাতে। কিন্তু এখান থেকে ব্যাংকিং শিখে গেলাম।' নজরুল, এসে দেখ, তোমার স্বপ্ন সফল করেছি। নজরুল দেশের জন্য তার বুকের রক্ত দিয়েছে কিন্তু আমরা তার জন্য কিছু করতে পারি না। নজরুল স্মরণে আজকে আমাদের দাবি, রামপুরা ব্রিজের নাম নজরুল ব্রিজ রাখা হোক। কেননা, সে প্রথম ঐ জায়গা দিয়েই ঢাকার ইলেকট্রিক স্টেশন নষ্ট করা শুরু করে। উল্লেখ্য, বাড্ডায় বিদ্যুত সংযোগ তার প্রচেষ্টাতেই দ্রুত বাস্তবায়ন হয়। আজকের এই শুভলগ্নে আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তার বিধবা স্ত্রী এবং পুত্র সন্তানের সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন কামনা করি।

লেখক : ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.