কী হয় এসব লিখে? by আবদুল মান্নান

মনে করেছিলাম ছাত্রলীগ নিয়ে আর কোন লেখালেখি করব না। কী হয় এসব লেখালেখি করে? বন্ধুবর ড. মুনতাসীর মামুন একবার এক মজার কথা বলেছিলেন।
তাঁর মতে দেশের পত্রপত্রিকায় এত যে লেখালেখি হয় তার পুরোটাই পণ্ডশ্রম। বেশির ভাগ লেখা মূলত তিনজন মানুষ পড়েন। লেখক নিজে, পত্রিকার যে পৃষ্ঠায় ছাপা হয় সেই পৃষ্ঠার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক, আর মাঝখানে প্রুফরিডার। মামুন আরও হলফ করে বলেন যাদের উদ্দেশে লেখালেখি হয় তারা কদাচিৎ এই সব লেখা পড়েন। পড়লে এবং লেখার মূল আবেদন যদি কিছুটা হলেও তাদের প্রভাবিত করত তাহলে তো সমাজের অনেক গুণগত পরিবর্তন হতো। তা তো হয় না। মামুনের মন্তব্য একেবারে ফেলে দেয়ার মতোও নয়। এই ধরা যাক ছাত্রলীগ বিষয়ে গত কয়েক মাস ধরে তাদের মূল দল আওয়ামী লীগ বিধ্বংসী কার্যকলাপ সম্পর্কে তো অনেক কিছুই লেখা হলো। তো তাতে করে কার কী হলো? বরং ফল তো হলো উল্টো। নিজেদের মধ্যে হানাহানি তো আছেই তার মধ্যে এখন যোগ হয়েছে হত্যা আর খুনখারাবি। তার ওপর এবার মাঠে নেমেছে ঢাকার সরকারী ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের মহিলা ক্যাডাররা। ভর্তি আর হলে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ তো আছেই, তার সাথে যোগ হয়েছে কিছু নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যকলাপের ভয়ঙ্কর অভিযোগ। ছাত্রলীগের এত সব কুকীর্তির কথা শুধু যে জামায়াত বিএনপির পত্রপত্রিকায় অথবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তা নয়, দেশের সকল মূল ধারার পত্রপত্রিকায়ও নিয়মিত ছাপা হয়। বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্লেষকরা ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করছেন, সংবাদপত্র সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করছে। এতসবের পরেও পরিস্থিতি খারাপ হতে খারাপতর হচ্ছে। তো লেখার চাইতে এ বিষয়ে সম্ভবত না লেখাটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত।
যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম এই বিষয়ে লেখালেখির ইতি টানব ঠিক তখনই আমার এক অনুজপ্রতিম সজ্জন সেদিন বিষণ্ন বদনে আমাকে অনুরোধ জানালেন তাঁর ব্যাপারটা আমার লেখায় যেন একটু তুলে ধরি। মনে করেছিলাম গুরুতর কোন কিছু হবে বুঝি। না যা শুনলাম তা পত্রপত্রিকায় ছাত্রলীগ বিষয়ক যা প্রকাশিত হয় সে তুলনায় একেবারেই নস্যি। অনুজের এ্যাপার্টমেন্টের দেয়ালে ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত ছাত্র শিবিরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ওপর বেশ কিছু পোস্টার সেঁটেছিল। পোস্টারগুলো দেয়ালে সপ্তাহ-দশদিন ছিল। এ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার তার রুটিন দায়িত্ব হিসেবে দেয়াল পরিষ্কার করতে গিয়ে পোস্টারগুলো তুলে ফেলে। বিপত্তি ঘটল এখানে। স্থানীয় ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কিছু নেতা এসে এ্যাপার্টমেন্টের যিনি অবৈতনিক সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন (ভদ্রলোক নিজে একজন প্রকৌশলী এবং ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন) তাকে তলব করল, তার সামনে বেচারা কেয়ারটেকারকে চড়থাপ্পড় মারল এবং এ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের ওপর পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করল। ওয়ার্ড ভাইদের সাথে অনেক কাকুতিমিনতি করে শেষমেশ কুড়ি হাজার টাকায় তার রফা হলো। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এখন বেচারা সেক্রেটারি ওয়ার্ড ভাইদের নিয়মিত টেলিফোন পান। তাঁরা তাঁর সাথে দেখা করবেন। কী প্রয়োজন তাদের তা তিনি মোটামুটি বুঝে গেছেন। তিনি এখন অনেকটা পলাতক জীবন যাপন করছেন। এরই মধ্যে তিনি তার পরিচিত আওয়ামী লীগের দু'একজন উঁচু পর্যায়ের নেতার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছেন। তারা বেশ সহানুভূতিশীল। তারা এমন মন্তব্যও করেছেন যে আগামীতে আওয়ামী লীগের যদি কখনও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে তাহলে তার সিংহভাগ দায়দায়িত্ব আজকের ছাত্রলীগের। অনুজের মতে তাদেরও বেশ অসহায় মনে হয়েছে। যে এ্যাপার্টমেন্টে এই ঘটনা সেখানে কুড়িটি পরিবার বাস করে। এসব পরিবারে শতের কাছাকাছি ভোটার আছে। একটি পরিবার আছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বিগত নির্বাচনে এই বিল্ডিংয়ের প্রায় সকলেই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। আগামীতে এমনটি নাও ঘটতে পারে। আমার সে অনুজ যে ইঙ্গিত দিল তা মনে হয় অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সম্ভবত এই কারণেই বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার চিকিৎসা শেষে বিমানবন্দরে পা দিয়েই বলেন আওয়ামী লীগের উচিত তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে দু'একটি সংসদ আসনে টেস্ট নির্বাচন দেয়া। অবশ্য খোন্দকার দেলোয়ারের বক্তব্য ইদানীং কেউ আর তেমন গুরুত্ব সহকারে নেন না। আর এ ধরনের বক্তব্য এ মুহূর্তে কিছুটা মামা বাড়ির আবদারের মতো। তবে পুরো বিষয় নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। অবশ্য সে চিন্তা কে করবেন তাও ভাবার বিষয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে এদেশের বৃহত্তম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যত না বেশি প্রতিপক্ষের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দলীয় অন্তর্ঘাতের কারণে। স্বাধীনতার পর পর দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা খন্দকার মোশতাক এই অন্তর্ঘাত শুরু করেছিলেন। ওই পর্ব শেষ হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার মধ্য দিয়ে। এর পর তো আওয়ামী লীগ অথবা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে, দেশীয় আর আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ১৯৯৬ এর সাধারণ নির্বাচনে জাসদ আর জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিলেন। দলীয় কিছু সাংসদ আর তাঁদের পুত্রদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে সেই সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে বেশি সময় লাগেনি। শেখ হাসিনার সেই আমলের অনেকগুলো ইতিবাচক অর্জন যেমন গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, সফল দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ, দক্ষিণবঙ্গে সর্বহারাদের অস্ত্র সমর্পণ সব বিফলে গিয়েছিল এই সকল সংসদ সদস্য ও তাদের গুণধর পুত্রদের কল্যাণে। এসব অপকর্মকে পুঁজি করেই ২০০১ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি নির্মাণ করেছিল 'সাবাস বাংলাদেশ' নামক প্রচারচিত্র। নির্বাচনে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। সেই পরাজয়ের পিছনে নানামুখী ষড়যন্ত্র কাজ করেছে তা সত্য তবে উল্লিখিত সংসদ সদস্য ও তাদের পুত্রদের অবদানও কম নয়।
যে সকল কারণে ২০০১ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছিল ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির হারার পিছনে এ রকম অনেক কারণ কাজ করেছিল। সাথে ছিল জোট সরকারের পাঁচ বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাস আর অতি অবশ্যই হাওয়া ভবন ফ্যাক্টর। সকলে ধরে নিয়েছিল এই পরাজয় হতে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠনগুলো অথবা তাদের নেতা নেত্রীরা শিক্ষা নিয়ে এমন কিছু করবেন না যাতে আবার আগামী নির্বাচনেও ২০০১ এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। অন্য সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও একটা জায়গায় এসে সম্ভবত আওয়ামী লীগকে হোঁচট খেতে হচ্ছে, আর তা হচ্ছে ছাত্রলীগ আর যুবলীগের আত্মবিনাশী কর্মকাণ্ড। গত এক বছরে শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহের মতো একটা ভয়াবহ সঙ্কট মোকাবেলা করেছেন। বিশ্বমন্দা সামাল দিয়েছেন, বছরের শেষ মূহূর্তে এসে স্কুল পাঠ্যবইয়ের গুদামে আগুন লাগা সত্ত্বেও সময়মতো পাঠ্যবই সরবরাহ করেছেন, দেশের সাধারণ মানুষকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাথে পরিচিত করানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু যেটি তিনি পারেননি তা হচ্ছে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা। তাদের কার্যকলাপে অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি তাদের অভিভাবকত্ব ছেড়েছেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কিছু।
বাংলাদেশে ভোটারদের একটি বড় অংশ সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও নির্বাচনের সময় তাদের ভোট নৌকায় মার্কায় পড়ে। তাদের বক্তব্য আর যাই হোক জামায়াত বিএনপিকে তো আর নিজের ভোটটা দেয়া যায় না। সুতরাং একমাত্র বিকল্প আওয়ামী লীগের সমর্থনে নৌকা মার্কায় ভোটটি দেয়া। অন্য বিকল্প হচ্ছে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া। সরকারের একজন সাবেক আমলা সেদিন ফোন করে আমাকে জানালেন ভাই পত্র পত্রিকায় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের খবর পড়ে ঠিক করেছি সামনের বার আর কাউকে ভোট দিতে যাব না। এ রকম বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা এমন চলতে থাকলে আগামীতে আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে তা বলাবাহুল্য ।
এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কিছুটা নাজুক সময় পার করতে হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হবে। তার আলামত পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা হলেও দেখা গেছে। সাথে যোগ হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া । বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে ছাত্র শিবিরের রগকাটা রাজনীতির নবযাত্রার মধ্য দিয়েও কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে। এ সবের সাথে ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, ক্যাম্পাস দখল, হল দখল, কোন্দল, সংঘাত, হত্যা, লুণ্ঠন, টেলিফোনে হুমকি আধিপত্যের লড়াই সব কিছুকে এক করলে তো শেখ হাসিনার সামনে চতুর্মুখী লড়াই ধেয়ে আসছে। কী করে তিনি এতগুলো ফ্রন্টে লড়াই করবেন? শেষ পর্যন্ত কী তাহলে ২০০১-এর পুনরাবৃত্তি হবে? এমনটি মনে করেন অনেকে। তবে তা হয়ত এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এমনও তো হতে পারে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আগেই তার লাগাম টেনে ধরবেন। সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করলেই তা সম্ভব। কারও কারও ধারণা ছাত্রলীগের পেশীশক্তিকে দুর্বল করে দিলে অন্যরা তার সুযোগ নেবে। আইন প্রয়োগ যদি সকলের ক্ষেত্র সমান ভাবে হয় তাহলে তা কেন হবে? ছাত্রলীগের বর্তমান সঙ্কট নেতৃত্বের সঙ্কট। সেটি ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। এই নেতৃত্বের পরিবর্তন না হলে এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির মৃত্যু নিশ্চিত। যে সংগঠনটি আওয়ামী লীগের জন্মের আগে বঙ্গবন্ধু জন্ম দিয়েছিলেন তার এমন পরিণতি নিশ্চয় শেখ হাসিনা বা তাঁর দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কেউ চান না। আর তা না চাইলে পরিস্থিতির মোড় ঘুরানোর সময় এখনই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকী ক'দিন আগে ছাত্রলীগ দলীয় সংঘাতের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছে। একজন নিম্নবিত্ত কৃষকের ছেলে। তার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আবু বকর প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। আর কিছু না হোক আবু বকরের স্মৃতির প্রতি সম্মানস্বরূপ ছাত্রলীগের উন্মত্ততা বন্ধ করার এখনই সময়।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ময়মনসিংহে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন পূর্ববঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী নুরুল আমিন। খুবই শক্তিশালী প্রার্থী। তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন যুক্তফ্রন্টের তরুণ ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ। তাঁকে নিয়ে ঢাকায় সাধারণ মানুষ এক অভূতপূর্ব বিজয় মিছিল বের করেছিল। আজকের ছাত্র 'নেতাদের' পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব নয় কারণ তাদের প্রায় কারও পক্ষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে বর্তমান অবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। জানি এসব লিখে তেমন কিছু হবে না। তার পরও অনুজের অনুরোধ রক্ষা করতে লেখা। অনুজ খবর দিল তার এলাকায় ছাত্রলীগের বাকি পোস্টারের ওপর একটি টমেটো সস কোম্পানি তাদের পোস্টার সেঁটেছে। এখন দেখার বিষয় তাদের কী হয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ ।

No comments

Powered by Blogger.