অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নেতৃত্বে এশিয়া

বিগত তিন বছর ধরে দেশী-বিদেশী সব পত্রিকায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার খবরই প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ব মন্দা শুরু হওয়ার পর দরিদ্রদেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থানে চলে গিয়েছিল।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উ্ন্নয়নের গতিতে দেখা দিয়েছিল মন্থরতা। আর প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলোকে বরণ করে নিতে হয়েছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগামিতা। চারদিকে শোনা যাচ্ছিল অর্থকষ্টের হাহাকার! বেকারত্ব,দেউলিয়াত্ব,বুভুক্ষতা,উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দের ঝনঝনানিতে ইতিবাচক শব্দমালা যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল। বিশ্বজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা রাজনীতিবিদ,অর্থনীতিবিদ,বিশেষজ্ঞসহ সকলের মাথাব্যথার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে নেয়া হচ্ছিল বহুবিধ পরিকল্পনা। কিন্তু আশায় গুড়ে বালির মতো সব কিছুতেই ব্যর্থতার প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোতে ঘটে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। সমস্যা উত্তরণের জন্য নেয়া হয় বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। যার ফলশ্রুতিতে এই বছরের শুরু থেকেই বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দীর্ঘ মন্দা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো। ইউরোপের চলমান সঙ্কট এখনও তেমনভাবে কাটেনি। যদিও আশা করা যাচ্ছে ইউরোপ ধীরে ধীরে সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এশিয়ার দেশগুলো বৈশ্বিক মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।
প্রথমেই আসা যাক ফিলিপিন্সের কথা। ফিলিপিন্সের অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বেড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতনের প্রতিনিয়ত আঘাতের বিপরীতে দেশটির অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী । ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২-তে ফিলিপিন্সের জিডিপি বেড়েছে ৬ দশমিক ৮। এদিকে দেশকে এ অঞ্চলের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত করতে চান ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো অ্যাকুইনো। অর্থনীতির নিম্নগতি রোধে তিনি সরকারী ব্যয় বাড়িয়ে এবং দুর্নীতি কমিয়ে দেশটিকে প্রায় বিনিয়োগমানের রেটিং এনে দিয়েছেন। প্রশাসনও সরকারী অর্থায়নে অগ্রগতিকে কারণ দেখিয়ে ঋণমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওর দেশটির রেটিংকে বিনিয়োগমানের কাছাকাছি অবস্থানে উন্নীত করেছে। গত ১২ মাসে দেশটির মুদ্রার (পেসো) মান ৬ শতাংশ বেড়েছে। ২৫টি উদীয়মান অর্থনীতির মুদ্রার ওপর পরিচালিত ব্লুমবার্গের জরিপে এটাই সবচেয়ে ভাল ফলাফল। দেশটির স্টক এক্সচেঞ্জও এ মাসে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। ব্লুমবার্গের জরিপে ফিলিপিন্স ২০১৪ সালের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি অর্থনীতির একটি হবে।
এরপর বলতে হবে তাইওয়ানের কথা। তাইওয়ানের জিডিপি বেড়েছে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। তাইওয়ান চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৩ দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশে উন্নীত করেছে। দ্বীপরাষ্ট্রটি আশা করছে, এ বছর চীন থেকে আরও বেশি পর্যটক ও বিনিয়োগ তাইওয়ানে আসবে। দেশটির প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীনে তাইওয়ানের রফতানি গত মাসে বেড়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১২ সালে দেশটির অর্থনীতি ১ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাইওয়ানের অর্থনৈতিক উর্ধগতি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, শিল্প রফতানিকারকনির্ভর দেশ হওয়ার কারণে এশিয়া অঞ্চল এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানার এক উৎকৃষ্ট মাপকাঠি তাইওয়ান ।
ছ্ােট দেশ সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল থাকলেও বিশ্বমন্দার কবলে পড়ে এখানে বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। আর এর ফলে দেশটির অর্থনীতিও ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। কিন্তু এই বছরের শুরু থেকেই পরিস্থিতি ঘুরে যেতে থাকে। বেকারত্বের হার কমতে থাকে। সিঙ্গাপুরে বর্তমান বেকারত্বের হার ১ দশমিক ৮ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে বেকারত্বের হার পাঁচ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন।
বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন বৈশ্বিক মন্দায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিছুটা সময় চীনের শিল্প উৎপাদনের প্রবাহ নিম্নমুখী থাকলেও এখন শিল্প উৎপাদন বাড়ছে। রফতানি বাণিজ্য,আবাসন খাতসহ প্রায় সকল অর্থনৈতিক খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামরিক খাতে ব্যয় কমানোর পর চীনের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ প্রণোদনা নীতির বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় চীন আবার তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী চার বছরের মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে চীন।
এশিয়ার অধিকাংশ দেশে প্রবৃদ্ধির উচ্চপ্রবাহ বিরাজমান থাকলেও জাপানের প্রবৃদ্ধিতে এখনও রয়েছে নিম্নমুখিতা। বৈশ্বিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চীনের সঙ্গে দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি জাপানের উৎপাদনের গতিও শ্লথ। গত ডিসেম্বরে দেশটির সার্বিক উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। জাপানের অর্থনীতির চিত্র নির্ভর করছে মজুরি ও ব্যয় খাতে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেয়া পদক্ষেপের বাস্তবায়নের ওপর।
দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর মাঝে ভারত অন্যতম। বর্তমানে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজমান। শিল্প উৎপাদনসহ রফতানি বাণিজ্য ভারতের অর্থনীতিকে দ্রুত শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধি ঘটছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ রেকর্ড আকারে বৃদ্ধি।
এশিয়া অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে। তাই আট বছর ধরে এশিয়ার অর্থনীতিকে পর্যবেক্ষণ করা ঋণমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা মুডিসের বিশ্লেষক গ্লেন লেভিন জানান, বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এশিয়া মূল নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির চলমান পুনরুদ্ধার অব্যাহত রয়েছে এবং এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সঙ্কুচিত হয়েছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম চললেও এখনও সফলতা ধরা দেয়নি। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বিরাজ করছে স্থবিরতা। জার্মানি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশ ইউরো সঙ্কট,ব্যয় সঙ্কোচন নীতির প্রভাবে সৃষ্ট বেকারত্বের প্রভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে আশা করা যাচ্ছে, এই সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনীতির পরিস্থিতির মন্দাভাবের মধ্যে দিয়ে থাকলেও বি¦শ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোই যে অগ্রগণী ভূমিকা পালন করছে তা নি:সন্দেহে বলা যায়।
মো: আরিফুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.