অভিমত- পল্লী বিদ্যুতায়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ- প্রকৌশলী by মোঃ সেলিম ভুঁইয়া

১৯৭৮ সালে কার্যক্রম শুরু করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও একটি অন্যতম প্রধান "অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাত" হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
দেশের পল্লী এলাকায় সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে শিল্প ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং ব্যাপক জনগণের জীবনমান উন্নয়নই পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের মুখ্য উদ্দেশ্য। সম্পদের সীমাবদ্ধতা, প্রযুক্তি, কারিগরি অবস্থান ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণে দেশের সকল অঞ্চলে পল্লী বিদ্যুতায়ন কর্মসূচী একসাথে বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর নয়। তাই দেশের সকল অঞ্চলকে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুত বিতরণের আওতায় আনবার উদ্দেশ্যে সরকারের অনুমোদন মোতাবেক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুতায়ন সমিতিসমূহ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। মহাপরিকল্পনায় রাজস্বের ক্রমানুযায়ী গ্রামগুলোকে সাজানো হয়েছে। কোন্ গ্রামের জন্য কি পরিমাণ লাইন প্রয়োজন এবং লোড চাহিদা কত তা মহাপরিকল্পনা থেকে জানা যায়।
মহাপরিকল্পনায় বর্ণিত রূপরেখা অনুযায়ী আগামী ২০২১ সালের মধ্যে সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতায়নের অবকাঠামো সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রিড লাইন সম্প্রসারণের কারিগরি ও আর্থিক দিক বিবেচনা করে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগের পার্বত্য এলাকা, উত্তর-পূর্ব ভাগের হাওর এলাকা, দক্ষিণের দীপাঞ্চল ও সুন্দরবন এলাকা গ্রিড লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন মহাপরিকল্পনার বাইরে রাখা হয়েছে। সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে এই সকল রিমোট এলাকা বিদ্যুতায়নের পৃথক একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চলতি মূল্যমানে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা। নির্মিতব্য অবকাঠামোর মধ্যে থাকবে প্রায় ৪৭০০০০ কিঃমিঃ বিতরণ লাইন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপকেন্দ্র ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম সমাপ্তির ফলশ্রুতিতে ২ কোটি পরিবার, ১৫ লাখ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ৪ লাখ সেচ পাম্প এবং ২.৫ লাখ শিল্প কারখানায় বিদ্যুত সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হবে। ফলশ্রুতিতে জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। ২০২১ সাল নাগাদ পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুত চাহিদার সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৫০০ মেঃ ওয়াট। যা বর্তমান চাহিদার ২৩০০ মেঃ ওয়াট-এর প্রায় তিনগুণ।
এলাকাভিত্তিক পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত সরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৫০০ কোটি টাকা। এ যাবত ৭০টি পল্লী বিদ্যুত সমিতি গঠন করে ৪৩৩টি উপজেলাকে পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যুতায়িত ৪৩৩টি উপজেলায় ২২০০০০ কিঃমিঃ বিতরণ লাইন, ৪৫০টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ/নবায়ন করে ৪৮০০০টি গ্রাম বিদ্যুতায়িত করা হয়েছে। বর্ণিত অবকাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে ৬৬ লাখ আবাসিক গ্রাহককে সংযোগ দেয়া হয়েছে যার মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি পরিবার বিদ্যুতের সুফল ভোগ করছে। এ ছাড়াও ৭৭০০০০টি বাণিজ্যিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ১৭০০০০টি সেচ পাম্পে, ১২৬০০০টি শিল্প কারখানায় এবং ১৩৩৪০টি রাস্তার বাতিতে বিদ্যুত সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। সকল শ্রেণীর সর্বমোট সংযোগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৮ লাখ। প্রতিদিন গড়ে ১৫০০টি হারে সংযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমগ্র পল্লী এলাকার ৯০% এরিয়া বিদ্যুতায়ন কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যুত সরবরাহ উপযোগী সম্ভাব্য গ্রাহকের ৪৫% বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। বাকি ৫৫% গ্রাহককে পর্যায়ক্রমে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের আওতায় আনার লক্ষ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
পল্লী এলাকা তথা সারাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রোপটে পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের শুভ প্রভাব ইতোমধ্যে প্রতিভাত হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক বিদ্যুত সংযোগের প্রত্যাশায় পল্লী বিদ্যুত সমিতি এবং এলাকার মন্ত্রী/সাংসদদের কাছে ভিড় করছে। মোট বিদ্যুত ব্যবহারের সিংহভাগ অর্থাৎ ৫৫% ব্যবহৃত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্প ও কৃষি খাতে এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে অবশিষ্ট ৪৫% ব্যবহৃত হচ্ছে গৃহস্থালী, শিক্ষা সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। এ যাবত বিদ্যুতায়িত ১৭০০০০টি সেচ পাম্পের মাধ্যমে প্রায় ৪০ লাখ একর জমি বৈদ্যুতিক সেচ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বছরে আনুমানিক ২০ লাখ টন খাদ্য শস্য অতিরিক্ত উৎপাদিত হচ্ছে। এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ১৫০ লাখ কৃষি শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সংযোগপ্রাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায় ১২.৫ লাখ দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। বর্তমানে পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে (পবিবোর্ড, পবিস, কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, হাউজ ওয়ারিং কাজ, বৈদ্যুতিক মালামাল উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান) কর্মরত কর্মকর্তা/ কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ যা হচ্ছে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
পরিচালিত এবং ইনসেনটিভাইজড ট্যারিফের (লস কমলে রেট কমে) কারণে সমিতিসমূহের ননটেকনিক্যাল লস বা বিদ্যুত চুরি নেই বললেই চলে। বিদ্যুত চুরি প্রতিরোধে গ্রাহক সদস্যরা অত্যন্ত সোচ্চার। সমিতিসমূহের বিলিং এবং কালেকশান সিস্টেম কম্পিউটারাইজড, গড় বিল আদায়ের হার ৯৮.৮২%। বিদ্যুত বিল খাতে পাওনার পরিমাণ ১.৫৫ মাসের গড় বিক্রির সমান। সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারী ও গ্রাহকদের জন্য চালু আছে অবিরত শিক্ষণ/প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যা মানব সম্পদ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। সমিতি সমূহের গ্রাহকপ্রতি মাসিক গড় বিদ্যুত ব্যবহার ৯৫ কিঃওয়াট আওয়ার। গ্রাহক প্রান্তে প্রতি ইউনিটের গড় ক্রয় মূল্য পড়ে ৩.১২ টাকা এবং গড় বিক্রয় মূল্য ৩.৭০ টাকা।
অন্যান্য পণ্যের মতো বিদ্যুত মজুদ করা যায় না। বিদ্যুতের উৎপাদন মানেই ব্যবহার। সংযুক্ত গ্রাহকদের বিদ্যুত ব্যবহারের চাহিদানুযায়ী বিদ্যুত উৎপাদন করতে হয়। কোন কারণে তা সম্ভব না হলেই তাকে বিদ্যুত ঘাটতি বলে। বিভিন্ন কারণে এই ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তন্মধ্যে অন্যতম কারণ হলো বর্তমানে স্থাপিত প্লান্টসমূহের সর্বোচ্চ উৎপাদন মতা (৪০০০ মেঃ ওয়াট) এর চাইতে সংযুক্ত গ্রাহকদের বিদ্যুত ব্যবহারের সর্বোচ্চ চাহিদা (৫৫০০ মেঃওয়াট) বেশি।
প্রতি বছর আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে গড়ে ১০% হারে (জিডিপির প্রায় দ্বিগুণ) অথচ সেই হারে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। বাস্তবায়িত না হওয়ার মূল কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দাতাদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং অর্থের অভাব। সিস্টেমের বৃহত্তর স্বার্থে উৎপাদিত বিদ্যুতের সাথে সঙ্গতি রেখে বিদ্যুত ব্যবহার করার জন্যই লোডশেডিং বা বিদ্যুত ছাঁটাই করতে হয়। বিগত সাত বছরে বিদ্যুত সেক্টরে চাহিদা বাড়লেও কাঙ্তি মাত্রায় বিদ্যুত উৎপাদন না বাড়ায় এই লোডশেডিং এখন আমাদের জাতীয় দুর্যোগ বা সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। উক্ত সমস্যা সাধারণত প্রকট আকার ধারণ করে প্রতি বছর সেচ মৌসুমে এবং গ্রীষ্মকালে পিকআওয়ারে (বিকাল ৫ট-১১টা)।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত পৌঁছাতে হবে। এ জন্য দরকার ২৫০০০০ কিঃ মিঃ বিতরণ লাইন, ৫০০টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং পুরনো লাইনের ব্যাপক পুনর্বাসন কাজ করা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের যে সামর্থ্য তাতে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ১৫০০০ কিঃমিঃ নতুন লাইন, ৩০টি সাবস্টেশন এবং ৫০০০ কিঃ মিঃ লাইন পুনর্বাসন করা সম্ভব। এই হারে অবকাঠামো নির্মাণ করলে ২৫০০০০ কিঃমিঃ লাইন নির্মাণ করতে তথা ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছানোর ল্ক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে ১৫ বছরের বেশি সময় লাগবে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পবিবোর্ড সরকারের কাছ থেকে ২% হারে এবং পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলো পবিবোর্ডের কাছ থেকে ৩% হারে দীর্ঘমেয়াদী (৫+২৫) বছর মেয়াদী ঋণ গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (BERC) কর্তৃক নির্ধারিত হারে বিদ্যুত বিক্রয়লব্ধ আয় দিয়ে বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য পরিশোধ, দৈনন্দিন পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ ছাড়াও সমিতিগুলোকে সরকারী ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। পবিবোর্ড/ পবিস উপবিধি অনুযায়ী প্রত্যেকটি পল্লী বিদ্যুত সমিতি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান (পৃথক সত্তা) এবং নো-লস নো প্রফিট ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাই প্রতিটি পল্লী বিদ্যুত সমিতির বিক্রয়মূল্য হার ভিন্ন ভিন্ন। বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে বিতরণ ব্যয়কে ভিত্তি ধরা আইনের বিধান। অক্টোবর-০৮ মাসে BERC কর্তৃক পবিসসমূহের ক্রয় মূল্য প্রায় ২৫% বৃদ্ধি করা হলেও বিক্রয়মূল্য ২০০২ সালের পর আর বৃদ্ধি করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে প্রায় সকল পল্লী বিদ্যুত সমিতিই বর্তমানে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বিদ্যুত বিক্রয়লব্ধ আয় দিয়ে সমিতিসমূহ পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে না। পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলো আর্থিক স্বনির্ভরতা তথা উত্তম গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার জন্যই বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্যহার পুনর্নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সরকার সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। এই বৃদ্ধির হার কৃষি সেক্টরসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে যা খুবই প্রশংসনীয়। প্রত্যেক মাসে বিদ্যুতায়নের যে প্রতিশ্রুতি সরকারের রয়েছে তার বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে আরও সুদৃঢ় প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.