যুদ্ধাপরাধীদের এ কোন্ ধৃষ্টতা! by ড. মারুফী খান

যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি হওয়ার অপেক্ষায় শুধু আমি নই, গোটা দেশবাসী। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ যে রায় ঘোষিত হলো, তার জন্য কি আমরা আসলেই প্রস্তুত ছিলাম?
দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও দীর্ঘ সময় পার হয়ে আমাদের দৃষ্টিশক্তিতে ঝাপসাভাবে এলেও ’৭১ আমাদের জীবনে যে ছাপ রেখে গেছে, সেখানে মিথ্যা, বানোয়াট বা গল্প বলে কিছু নেই! থাকতে পারে না!
জেলহত্যার বিচারের রায়েও একটি লেখা লিখেছিলাম! সেটি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররা নিয়ে ছেপেছিল; আজ আবার কলম ধরতে আগ্রহী হয়েছি কারণ কাদের মোল্লার শাস্তি আমাদের শুধু হতাশ করেনি, অবাক করেছে। পাঁচ পাঁচটি অপরাধ নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর কেন তার শাস্তি যাবজ্জীবন? আইনের প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং সম্মান রেখেই বলছি- আমরা যারা ’৭১-এর দিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি, তারা এই রায়ে বিস্মিত হয়েছি!
এই রায়ের বিরোধিতা করে জামায়াত আবার হরতাল ডেকেছে। আমরা রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ, র‌্যাব দিয়ে পাহারা দিচ্ছি কিন্তু কেন আমরা অন্তত কয়েক কোটি জনতা রাস্তায় বসছি না এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে- আমরা পানি স্পর্শ করব না যতক্ষণ না এ আদেশ উচ্চ আদালতে রদ হয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি, যুদ্ধে কেউ সরাসরি অংশ নিয়েছে। কেউ পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে। আমাদের তো এখন একত্র হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কথা।
মেহেরুননেসা ’৬৬ সাল থেকে আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় আসতেন। রোগা ছোটখাটো মহিলা, সাদা শাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মিরপুর থেকে ধানমণ্ডি সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষায়ত্রী আমার মা, তাঁর কাছে প্রায়ই তিনি আসতেন। নির্লোভ, অতি সাধারণ এক মহিলা কিন্তু দৃঢ়। সংসারে ভাইবোনদের মানুষ করার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। আমার মায়ের স্নেহময় সাহচর্য তাঁকে হয়ত শান্তি, ভালবাসা দিত, তাই তিনি আসতেন।
এ রকম অজস্র মেহেরুননেসাকে আমরা হারিয়েছি, খুঁজে পাইনি ’৭১-এর সংগ্রামে, তাঁদের অপরাধ ছিল না। চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত। দীর্ঘ চার দশক যে বিচারের আশা বুকে জিইয়ে রেখে জাতি অপেক্ষা করেছে তার কি উত্তর আজ পাওয়া গেল?
আজ পত্রিকায় ছবি দেখি কাদের মোল্লার ‘বিজয়’ চিহ্নিত ছবি। ছিঃ, আমার সত্তাকে। এই বিজয় উল্লাস আমরা দেখছি, টেলিভিশনের পর্দায় আমরা আসামি পক্ষের উকিলের কথা শুনছি, শুনছি বাদী পক্ষের উকিলদের বিমর্ষ কণ্ঠস্বর। বিচারের বাণী কি এমনিই নীরবে কাঁদবে, কাঁদাবে আমাদের?
আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের দেশপ্রেমিক হতে স্বপ্ন দেখাতে চাই। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হতে সাহস আর জ্ঞান দিতে চেষ্টা করি। বলি, প্রকৃত ইসলাম বড় সুন্দর। বলি কোরআনের অর্থকে যথাযথভাবে হৃদয়ে ধারণ কর। হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবন যদি সত্যিকার জ্ঞানদ্বারা বুঝতে সক্ষম হও, জানবে তুমি প্রকৃত মুসলিম! ‘একজন প্রকৃত মুসলমান সেই-ই যার মুখ ও হাত থেকে আরেকজন নিরাপদ।’ তাহলে ’৭১-এর সেই দিনে কি অপরাধ ছিল অগণিত নিষ্পাপ নাবালিকা, তরুণীদের কি অপরাধ ছিল অন্য ধর্মের অসহায় মানুষের? তাদের যারা ধরিয়ে দিয়েছিল, ধরে এনে নিজেরা কিংবা পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে উলঙ্গ করে, সম্ভ্রম লুটেছিল, তাদের কাছ থেকে ঐ মুসলমানরা নিরাপদ ছিল না? অন্য ধর্মের মানুষ যদি আমার ধর্মকে আঘাত করে, তাহলে তা প্রতিহত করার নাম ‘জিহাদ’, কিন্তু ’৭১-এ আমরা কি দেখেছিলাম? কাদের মোল্লা গং যা করেছিল বা বাচ্চু রাজাকার যা করেছিল তা কি মুসলমানের কাজ হয়েছিল? ছোট শিশুকে, নারীকে হত্যা করলে ফাঁসি হয়, এটাই প্রমাণিত সত্য। তাহলে আদালত বসিয়ে এতসব কা-ের পর কাদের মোল্লা ‘ঠ’ চিহ্ন আমরা দেখি কেন? কাদের ভয়ে আমাদের এই হাস্যকর সময় প্রত্যক্ষ করা? আমরা আবার পাকিস্তান হব? আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, নিয়মিত জাকাত দিই, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করি, হজ করি তাহলে আমাদের থেকেও বড় মুসলমানরা আমাদের ‘ইসলাম’ শিখাতে উদ্যোগী হয়? ইসলামিক বিধান মতে যে শাস্তি এই আসামিদের জন্য প্রযোজ্য তাইই দিল না কেন? মাটিতে পুঁতে কঙ্কর নিক্ষেপ করাও তো এই অপরাধীদের জন্য যথেষ্ট নয় বলে আমাদের বিশ্বাস।
এ দীর্ঘ চল্লিশ বছর আমরা স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলে যাইনি। দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে, ইতিহাস তো ঝাপসা হবার নয়? এই ঢাকা শহরে আপনারা অনেকেই বদ্ধভূমির খোঁজ করেছেন। কিন্তু এমন জায়গাও এই শহরে আছে যেখানে সংখ্যাতীত বাঙালীর লাশ গর্ত করে পুঁতে ফেলে তাতে রাসায়নিক পাউডার মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে আজ সবুজ দূর্বার মাঠ! কোন এক তরুণী গ্রিল এর ভিতর থেকে বাইরে পালিয়ে গিয়েছিল বলে পুরো জানালাই ইট গেঁথে বন্ধ করে দেয়া আছে। এসব গল্প নয়, সত্য এবং ইতিহাস।
আমাদের আহ্বান যুব সমাজের প্রতি, যারা চাক্ষুস করেনি ’৭১ কিন্তু শুনেছে আমাদের বাক্য দিয়ে, দর্শন করেছে আমাদের দেখা দিয়ে, হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করেছে আমাদের হৃদয়ক্ষরণ দেখে! তারাই শক্তি! ধর্মের নামে অধর্ম মানা যায় না, আমরা ধার্মিক, আমরা ধর্মান্ধ হতে চাই না। যে যুবকরা কতিপয় নেতাকর্মীর উস্কানিতে রাজপথ, জনপথে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা একবার ভেবে দেখুক। তারা একবার তাকাক তার নিজের মা-বোনদের দিকে। বৃদ্ধ পিতার দিকে। মোঃ ইকবাল-এর একটি লেখা বড় ভাল লেগেছিল। (তাঁর অন্য লেখারও অনুরাগী আমি) যারা শিবির করে তাদের উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন! ওদের কি চৈতন্য হয় না? এত প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি! তবু আশা, তবু ভরসা আমাদের তরুণ সম্প্রদায়ের ওপর। সোচ্চার হও! মিথ্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও! অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হও।
আজ সকালেই আমার কাছে যে মহিলাটি সাহায্য করে কাজে, বলছিল সে হরতাল বোঝে, বোঝে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিতে যেতে পারছে না। তারপর একটা মোক্ষম প্রশ্ন করে বসে আপা, ধর্ষণ কি? বলি, তোমার মেয়ে আছে যে, তাকে যদি কেউ নিয়ে যায় ধরে আর তার ওপর অত্যাচার করে একজন নয় অনেকজন, তাহলে...। সে আঁতকে ওঠে! চিৎকার করে অভিসম্পাত দেয় ‘রাজাকার ‘রাজাকার’ বলে! এই হচ্ছে বোধোদয় ঘটান! আজকের তরুণ তোমাদের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের সোনার বাংলাদেশ। আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি কত নিঃস্ব, অসহায় পিতা-মাতার সন্তান একটু সহযোগিতা পেয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, হচ্ছে। বলি উচ্চ শিক্ষার জন্য অবশ্যই বিদেশে যাবে জ্ঞান অর্জন করতে, কিন্তু ফিরে আসবে এ দেশে, এই জন্মভূমিতে। এ মাটির ঋণ যে তোমার শিরা-উপশিরায়।
আমি একজন শিক্ষক হিসেবে আত্মঅহমিকায় স্নাত হই- আমার সন্তানেরা স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে। ‘তুই রাজাকার’ ‘তুই অপরাধী’ বলার মতো সাহস আমার মতো আমার ছাত্র-ছাত্রী সন্তানেরাও অর্জন করেছে, এই বিশ্বাস নিয়েই বলি-মহান সৃষ্টিকর্তা, অপরাধীকে শাস্তি দিন!!

লেখক : অধ্যক্ষ, ইস্পাহানী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, মগবাজার, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.