কোন্ পথে বাংলাদেশের ক্রিকেট! by আরিফুর রহমান বাবু

২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১০টা। টেলিফোনে মাশরাফির ধরা গলা, আমাকে বিশ্রাম দিতে চেয়েছে, বলেছে কালকের ম্যাচে তুমি বিশ্রামে থাকো। আমি বুঝেছি, এটা আসলে বিশ্রাম নয়, ড্রপ।
তাই মনের দুঃখে হোটেল ছেড়ে বাসায় চলে এসেছি। এ সিরিজে আর খেলবো না। চট্টগ্রামে শেষ ওয়ানডেতেও না। টিম ম্যানেজমেন্ট যদি চায়, না। তাও না। আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। আমাকে এভাবে দলে নিয়ে আবার বাইরে ঠেলে দেয়া কেন? তাহলে না নিলেই চলত। নিলোই যখন, তখন এক ম্যাচ খেলার পর আবার বিশ্রামে থাকার কথা কেন উঠছে। এ যে অনেক যন্ত্রণা_ হতাশার। আমি বলে বোঝাতে পারবো না, মন কতটা খারাপ। আমার প্রায় ৭/৮ বছরের ক্যারিয়ারের এত দুঃখ আর যন্ত্রণা বোধকরি অনুভব করিনি। আরও খারাপ লেগেছে, বিশ্রামের কথা শুনে। আসলে কি তাই? আমি কি মাঠে বল করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছি? কিংবা ফিল্ডিংয়ের সময় দৌড়াতে গিয়ে পারিনি, ব্যথার যন্ত্রণায় কুঁকরে উঠেছি। তাহলে কেন এমনটা বলা হচ্ছে?
দৃশ্যপট ২ মাশরাফির অনুমানই আসলে ঠিক। আসলে তাঁকে বাদই দেয়া হয়েছিল। তার প্রমাণ, কোচ জেমি সিডন্সের বক্তব্য। এ অস্ট্রেলিয়ানের সোজাসাপটা উচ্চারণ, মাশরাফিকে বিশ্রাম নয়, ড্রপ দেয়া হয়েছে। তাঁকে উদ্ধৃত করে ক্রিকইনফোর এ্যান্ডু্র মিলার তা লিখেও দিয়েছেন।
সেই থেকে শুরম্ন। তারপর যা ঘটেছে, তা অনাকাঙ্ৰিত-অনভিপ্রেত। ঠিক কাদা ছোড়াছুড়ি না হলেও কিছু বিচ্ছিন্ন কথা বার্তা হয়েছে। যা অনায়াসেই এড়ানো যেত। খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো ডালপালা ছড়িয়েছে। গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছে। মোদ্দাকথা একটা গুমোট আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নীল আকাশে এক চিলতে কালো মেঘ জমেছে। ইচ্ছায় হোক আর বয়স ও অভিজ্ঞতায় কম থাকার কারণেই হোক, মাশরাফি উপাখ্যানে অলৰ্যে জড়িয়ে পড়লেন শাকিব আল হাসানও। মিডিয়ায় মাশরাফির দলে থাকা_না থাকা সম্পর্কে মনত্মব্য করে ফেললেন। এ মুহূর্তে মাশরাফি ভাইয়ের দরকার নেই, সরাসরি এমন কথা বলেননি। তবে দলে তাঁর অনত্মভর্ুক্তি জরম্নরি, তাঁর মতো উঁচুমানের এক ক্রিকেটারকে নিয়ে এভাবে টানাহেঁচরা মোটেই কাঙ্ৰিত নয়_তাও বলেননি। যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো_এখন দলের যা অবস্থা তাতে বর্তমান মাশরাফি ভাই না থাকলেও তেমন সমস্যা নেই। এ মনত্মব্যটা অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়া যেত। প্রচারমাধ্যম মাশরাফি ইসু্যতে তাঁর মতামত চেয়েছে। এটা দোষের কিছু নয়। বরং সেটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের তাবৎ প্রচারমাধ্যম তাই করত। বাংলাদেশ মিডিয়াও তাই করেছে। শাকিব সেখানে কোন মনত্মব্যে না গিয়ে বলে দিতে পারতেন, ভাই এটা একটা স্পর্শ কাতর বিষয়, আমার কথা না বলাই ভাল। আর সিদ্ধানত্মটা একানত্মই নির্বাচকদের। তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন। আমি কিছু বলতে চাই না। ব্যাস এটুকু বললেই ল্যাঠা চুকে যেত। কোন বিতর্কই সৃষ্টি হতো না। শাখা-প্রশাখাও গজাতো না।
আশার কথা, বিষয়টি আর সেভাবে বিসত্মৃত হয়নি। বোর্ড সরাসরি হসত্মৰেপ না করলেও পত্রপত্রিকায় বিসত্মর লেখলেখির কারণে নীতিনির্ধারণী মহলে নাড়া পড়েছে। তার প্রভাবে মাশরাফি-শাকিব দুজনই ধীরে ধীরে সংযত ও পরিণত আচরণ করেন। মোদ্দাকথা, সে কালো মেঘ সরে গেছে। অর্থাৎ, মাশরাফি দলে ঢোকা এবং বিশ্রাম নাটক নিয়ে সৃষ্ট চিত্রনাট্য তথা উপাখ্যানের ইতি ঘটেছে। শাকিব সব কিছু ঝেরে ফেলে চট্টগ্রামে টেস্ট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাশরাফিও নিজেকে আবার ফিরিয়ে আনার কঠিন সংকল্পে গেছেন আইপিএল খেলতে গেছেন। আর যিনি ক্রিকইনফোর কাছে মাশরাফি ড্রপ বলে গরম কড়াইতে তেল ঢেলেছিলেন, সেই কোচ জেমি সিডন্সও মাশরাফির আইপিএল খেলতে যাবার সিদ্ধানত্মকে সময়োপযোগী বলে মনত্মব্য করেছেন। এসব দেখে ও শুনে মনে হতেই পারে, সৃষ্টি হওয়া অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ৰিত ঘটনার ইতি ঘটেছে। কিন্তু আসলে কি তাই? বাংলাদেশ দলের অভ্যনত্মরে কি কোনই সমস্যা নেই? টিম বাংলাদেশ কি সত্যিই এক সুতোয় গাঁথা ? সদ্ভাব, সম্প্রীতি, মায়া-ভালবাসা, পারস্পরিক সমঝোতা ও সত্যিকার সংহতি কি আছে? কেউ হলপ করে বলতে পারবেন? কোচ জেমি সিডন্স, ম্যানেজার সফিকুল হক হীরা, সহকারী প্রশিৰক খালেদ মাহমুদ সুজন, অধিনায়ক শাকিব আল হাসান আর সহ-অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমরা এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন দলের ভিতরে কোন সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও গ্রম্নপিং নেই? পারবেন না। কারণ ওদের জানা, ভেতরে ভেতরে এর ওঁর সঙ্গে লাগালাগি, মতের ও পথের অমিল আছেই। সেটা সব দলেই কিছু না কিছু থাকে। এমন যে অস্ট্রেলিয়া-দৰিণ আফ্রিকা তাদেরও আছে। বাইরে থেকে যতই মিল-মহব্বত আর খাতিরই মনে হোক না কেন, সব দলের অভ্যনত্মরেই কিছু না কিছু সমস্যা আছে। সেটা মানুষ মাত্রই থাকে। এক পরিবারেও নানা মত ও আদর্শ থাকে। ১৪/১৫ জনের দলে মতের অমিল থাকা তাই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দল হিসেবে দাঁড়াতে হলে সেই সমস্যা যত সম্ভব কমিয়ে ফেলতে হবে। নিজেদের ভেতরে সমস্যা নিয়ে আর যাই হোক মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে না।
মনে রাখতে হবে, আনত্মর্জাতিক ক্রিকেটে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে সবার আগে দরকার টিম পারফরমেন্স। শুধু এখনকার মতো কিছু ব্যক্তিগত পারফরমেন্স পুঁজি করে কোনভাবেই দল হিসেবে ওপরে ওঠা যাবে না। যায় না। কেউ তা পারেনি। সেই টিম পারফরম্যান্স তখনই আসবে, যখন পুরো দল একটা ইউনিট হিসেবে গড়ে উঠবে। ভেতরে দ্বন্দ্ব আর উপদলীয় কোন্দল থাকলে কোনদিনই টিম পারফরম্যান্স হবে না। টিম পারফরম্যান্সের পূর্বশর্তই হচ্ছে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসা। মাঠে ভাল খেলার আগে সবাইকে একমত থাকতে হবে। যে করেই হোক, আমাদের ভাল খেলতে হবে। টিম বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে। এই চিনত্মা যতৰণ না থাকবে, ততৰণ ভাল খেলার তাগিদ সবার ভেতরে আসবে না। এখনকার মতো কেউ কেউ ব্যাট ও বল হাতেই বিচ্ছিন্নভাবে জ্বলে উঠবেন। পুরো দল একত্রে জ্বলে ওঠা কঠিন হবে। আর সম্প্রীতি, ঐক্য আর সংহতি থাকলে আপনাআপনি টিম স্পিরিট বেড়ে যাবে। পুরো দলকে মনে হবে এক সুখী পরিবার।
সবাই সেই হাসি খুশি পরিবারই দেখতে চায়। কিন্তু তা না করে নিজেদের মাঝে উপদলীয় কোন্দলে জড়ালে চরম ৰতি হবে। খুব বেশিদূর যেতে হবে না, পাকিসত্মানের দিকে তাকালেই চলবে। শুধু উপদলীয় কোন্দলেই আজ দলটির কি করম্নণ অবস্থা। এক সময়ের মহাশক্তি পরম পরাক্রমশালী পাকিসত্মান এখন সাদামাঠা এক দল। সম্প্রীতি, ঐক্য, সংহতির বালাই নেই। পারস্পরিক শ্রদ্ধা নেই। একজন সর্বৰণ আরেকজনের পেছনে লেগে থাকে। অমুকে চলে না। তাঁকে নেয়ার যৌক্তিকতা নেই। ওকে নিলে আমি খেলব না। ওর নেতৃত্বর যোগ্যতা নেই। ওর ক্যাপ্টেন্সিতে আমি খেলব না। এসব কথাবার্তা প্রতিদিনই কমবেশি মিডিয়ায় আসছে। ঐক্য, সম্প্রীতি আর সংহতি না থাকায় যে দলাদলি ও পারস্পরিক অশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে। যে কারণে অধিনায়ক বদল হচ্ছে নিরনত্মর। আজ শোয়েব মালিক, কাল ইউনুস খান, পরশু মোঃ ইউসুফ আর তারপর আফ্রিদিকে অধিনায়ক করা হচ্ছে। এভাবেই চলছে পথ চলা। তাতে করে তেজ, শৌর্য-বীর্য কমেছে অনেকখানি। পাকিসত্মান এখন আর কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। জিততে ভুলে যাওয়া প্রায় সাধারণ দল। এখন থেকে নিজেদের না শোধরালে বাংলাদেশও কিন্তু অমন হয়ে যাবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি থাকতেই হবে। কেউ একটু ভাল পারফমার থাকতেই পারেন। সেটা সব দলেই আছে। কারও মেধা-যোগ্যতা একটু বেশি থাকতেই পারে। সব দলেই থাকে। তাই বলে অহংবোধ, দম্ভ থাকার কিছু নেই। কারও একার নৈপুণ্যে দল তলানি থেকে ওপরে উঠতে পারবে না, যতৰণ না বাকি সবার গড়পড়তা অবদান না থাকবে। এই কঠিন সত্য উপলব্ধি করতে হবে। সবার অবদান দরকার। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য সম্প্রীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সংহতি অতি জরম্নরী। বেশিরভাগ তরম্নণ। গড় বয়স ২২/২৩। ওদের ঐক্যবদ্ধ করতে আসলে কয়েকজন সিনিয়র পারফরমার বিশেষ করে একজন সৎ, যোগ্য ও সত্যিকার নেতার দরকার ছিল। ঠিক খালেদ মাহমুদ সুজনের মতো। তা নেই। গড়পড়তা সবাই কাছাকাছি বয়সের। সর্বোচ্চ পার্থক্য দুই থেকে তিন বছরের। কাজেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি গড়ে তোলায় একটু প্রতিবন্ধকতা আছে। এই ঘাটতি পোষাতে দরকার বোর্ডের হসত্মৰেপ। জাতীয় দল ব্যবস্থাপনায় আরও চোখ কান খোলা রাখা দরকার। কোনরকম দলবাজি, ব্যক্তিগত দম্ভ, ঔদ্ধত্য বন্ধে দরকার কার্যকর হসত্মৰেপ এখনই দরকার।

No comments

Powered by Blogger.