ওদের জীবনধারা বদলে দিয়েছে সৌর বিদ্যুত by রশীদ মামুন

পিচ ঢালা রাস্তা, ইটের ঘর, মোবাইল নেটওয়ার্ক সবই আছে কিন্তু মাইলের পর মাইল যাওয়ার পরও চোখে পড়ছিল না খাম্বা বা বৈদ্যুতিক তার। রাত নামলে চারদিক ভুতুড়ে অন্ধকারে ছেয়ে যাবে ভাবতে ভালই লাগছিল।
কিছুক্ষণবাদে রাত নামল ঠিকই কিন্তু চারপাশ আলো ঝলমলে। বাজরের দোকানে দোকানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। গ্রামের ঘরে ঘরে টিভি চলছে। মুহূর্তেই রিমোট চেপে গৃহিণী চ্যানেল বদলে দিচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা ঝলমলে আলোয় বসে পড়ছে। একটু অবাকই হলাম জেনারেটর, না কোথাও কোন শব্দও নেই! শুনলাম এখানে শহরের মতো ঘন ঘন বিদু্যত চলে যাওয়ার ঝক্কিও নেই। তাই কেরোসিনের বাতিকে সেই কবেই ওরা জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। অবাকই হলাম বিদু্যতই নেই তার আবার চলে যাওয়া! টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার কস্তুরিপাড়া গ্রামের গল্প এটি। শুধু কস্তুরিপাড়াই নয় নওয়াবাড়ি, চিংনা, ছোট ভা-ার, পারথিসহ আশপাশের সবগুলো গ্রামই সৌর বিদু্যতের আলোয় আলোকিত।
সৌর কোষকে আলোকশক্তি থেকে বিদু্যত শক্তিতে রূপানত্মর করে ব্যবহার করছে কালিহাতির এসব গ্রামের মানুষ। সৌর কোষ হচ্ছে এক ধরনের শক্তি রূপানত্মরকারী ইলেকট্রনিক যন্ত্র। অনেকগুলো কোষ একত্রে সংযুক্ত করে সৌর প্যানেল তৈরি করা হয়। প্যানেলের ওপর সূর্যের আলো পড়লেই ভোল্টেজ সৃষ্টি হয়। আর তা ব্যাটারিতে ধরে রেখে রাতের অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সব সুবিধা ভোগ করছে এরা।
বিদু্যত যে কিভাবে ওদের জীবনকে বদলে দিয়েছে কাছ থেকে না দেখলে তা বোঝাই যাবে না। কৃষি নির্ভর এসব গ্রামে গড়ে উঠেছে কৃষিভিত্তিক শিল্প। বাড়তি আয়ের সংস্থান হওয়ায় দারিদ্র্যকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে ওরা। এখন এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম, তার অংশ হিসেবে ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছে কেউ কেউ কলেজেও যাচ্ছে। ২১ শতকের উন্নয়নধারার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে ওদের এই প্রচেষ্টা।
কস্তুরিপাড়ার লাইলি বেগম জানালেন, সৌর বিদু্যত পাওয়াতে এখন তার অনেক সুবিধা হচ্ছে। সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে ছেলেমেয়ের পড়ালেখায়। আগে সন্ধ্যা নামতেই ওদের ঘুম পেত, এখন আর তা হয় না। সৌর বিদু্যত পাওয়াতে তিনি টেলিভিশন থেকে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে জানতে পারছেন বলে উলেস্নখ করেন।
ষাটোর্ধ জয়গুন জানান, আগে রাত নামলে অন্ধকারে তিনি বাইরে বের হতে পারতেন না। এখন রাতকেও দিনের মতো মনে হয়। সৌর বিদু্যত থাকায় তার ঘরে মোবাইলে চার্জ হচ্ছে। ইচ্ছা করলে তিনি তার বাইরে থাকা ছেলেদের খবর নিতে পারছেন। কখনও ভাবেনওনি শেষ বয়সে প্রযুক্তি তার জীবনকে এতটা বদলে দেবে।
শুধু লাইলি বা জয়গুনই নন বিদু্যতের আলো পেয়ে সবাই একই রকম খুশি। বিনোদন আর লেখাপড়াই নয় সৌর বিদু্যতের আলো মানুষের কর্মঘণ্টাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাতটুকু দিনির মতো আলোকিত হওয়ায় আরও বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারেন এঁরা। দোকানি জয়নাল আবেদীন জানালেন, আগে সন্ধ্যা হতে না হতে তাঁকে দোকান বন্ধ করতে হতো। বেচাকেনা বেশি হলে হ্যাজাক বাতি জ্বালতে হতো। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কেরোসিনের খরচ হওয়ায় তা সবসময় সম্ভব হতো না। সৌর বিদু্যত অনেক সাশ্রয়ী উলেস্নখ করে জয়নাল বলেন, এখন আমি যেমন বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারছি, আবার আমার খরচও কমে গেছে। চার বছর আগে সৌর বিদু্যত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
হোসেন আলী শিকদার গ্রামেই একটি মুরগির খামার করেছেন। তিনি জানালেন তাঁর খামারের মুরগিকে সর্বনিম্ন ১৬ ঘণ্টা আলোতে রাখতে হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার বেশি আলো পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। সৌর বিদু্যত তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে বলে জানান হোসেন আলী।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে দেশের প্রায় ৫৩ ভাগ মানুষ বিদু্যতসুবিধা বঞ্চিত। এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে গ্রিডলাইন নেই। প্রত্যনত্ম অঞ্চল হওয়ায় এসব এলাকায় বিদু্যত পেঁৗছে দিতে বিপুল বিনিয়োগের দরকার। আবার আধুনিক জীবন যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বিদু্যতের কোন বিকল্প নেই। সে ৰেত্রে সৌর বিদু্যতই হতে পারে একমাত্র ভরসা। বিশ্বব্যাংক দেশের সৌর বিদু্যত খাতে সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, তারা নতুন করে ৩ লাখ গ্রাহককে সৌর বিদু্যত সুবিধা দিতে যাচ্ছে। ইডকলের হিসেবে কালিহাতিতে ২ হাজার ৪৪৫ জন ভোক্তা সৌর বিদু্যত ব্যবহার করছেন। গ্রামীণ শক্তি, পলস্নী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, রম্নরাল সার্ভিস ফাউন্ডেশন, সৃজনী বাংলাদেশ, ব্র্যাক ফাউন্ডেশন, টিএমএসএসের মতো কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছে সহজশর্তে সৌর বিদু্যত পেঁৗছে দিচ্ছে। মোট মূল্যের ১৫ ভাগ অগ্রিম দিয়ে দুই থেকে চার বছর মেয়াদী মাসিক কিসত্মিতে যে কেউ সৌর বিদু্যত নিতে পারেন। কালিহাতিতে এসব প্রতিষ্ঠান ফ্রি সার্ভিসও দিচ্ছে। এৰেত্রে সৌর প্যানেলের ২০ বছর এবং ব্যাটারির ৫ বছর গ্যারান্টি দেয়া হয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠানই সৌর বিদু্যত বিক্রির ১০ বছর পার করলেও এখনও ব্যাটারি নষ্ট হয়নি। প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৮৫ ওয়াটের ৫ ধরনের সৌর বিদু্যত ইউনিটের দর ২১ হাজার ৬০০ থেকে ৪২ হাজার ৬০০ টাকার ভেতরে বলে জানান বিক্রেতারা।

No comments

Powered by Blogger.