ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিতে বললেন খন্দকার মাহবুব by শরীফুল ইসলাম

 জামায়াতের কারণে শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না বিএনপি। দলের একটি অংশ এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করলেও জামায়াতের চাপের কারণে বিএনপি হাইকমান্ড এ আন্দোলন থেকে দূরে থাকার কৌশল নিয়েছে।
তবে এ ইস্যুতে বিএনপি হাইকমান্ড নীরব থাকার চেষ্টা করলেও দলের নেতারা একেকজন একেক রকম করে মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন। আর শাহবাগে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলন ও বিএনপির দূরত্ব বজায় রাখার কারণে জামায়াত নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন একঘরে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে। তবে তারাও চলমান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে জামায়াতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারে নিয়োজিত ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবি তুলেছে বিএনপি। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি করেছেন।
প্রসঙ্গত অনেক আগে থেকেই জামায়াত ট্রাইব্যুনাল ভাঙ্গার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু এতদিন বিএনপির পক্ষ থেকে এ দাবি না জানালেও এখন কেন তারা এ দাবি করছে তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেক বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। অথচ ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছিলেন জামায়াতের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবির সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। মাত্র ৫ দিন পর বিএনপি কেন অবস্থান পরিবর্তন করে ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিল তা নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে নীরবতা পালনের পাশাপাশি আপাতত জামায়াতের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচী পালন না করার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এ কারণে ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের পর বিএনপি এ বিষয়ে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তার পাশাপাশি জামায়াতের সঙ্গে কোন যৌথ কর্মসূচীও পালন করেনি। ৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ১৮ দলীয় জোটগতভাবে নয়াপল্টনে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দিলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এ কর্মসূচী স্থগিত করে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয় পুলিশ প্রশাসন থেকে অনুমতি না পাওয়ায় তারা নয়াপল্টনে এ কর্মসূচী পালন করতে পারেনি। কিন্তু একই ভেন্যুতে শনিবার বিকলে ঢাকা মহানগর বিএনপি বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে প্রমাণ করেছে যে কারণ দেখিয়ে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে তা সত্য নয়। আসল সত্য হচ্ছে জামায়াতকে নিয়ে কর্মসূচী পালন করলে সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়ার ভয় থেকেই তারা এ কৌশল নিয়েছে। তবে বিএনপি এ কৌশল নেয়ায় জামায়াত তাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, জামায়াতের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্নও উত্থাপন করা হয়েছে যে যদি অনুমতি না পাওয়ার কারণে জোটগত কর্মসূচী স্থগিত করা হয় তাহলে একই ভেন্যু ও একই সময়ে বিএনপি কীভাবে সমাবেশ মিছিল করেছে।
শনিবার বিকেলে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা আক্ষেপ করে বলেন, এতকিছুর পরও বিএনপি কেন জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছে না তা আমরা বুঝতে পারছি না। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করে আগামী দিনে জামায়াতকে মাইনাস করে আন্দোলন জোরদার না করলে বিএনপিকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। তবে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই চাচ্ছে অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের কারণে জামায়াত প্রশ্নে অবস্থান পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির আরেক নেতা বলেন, দুর্দিনে জামায়াত বিএনপির পাশে ছিল। এখনও বিএনপির দুর্দিন কাটেনি। একদিকে দলের নেতাকর্মীদের মাথার ওপর মামলার খড়গ এবং অপরদিকে সারাদেশেই দল অগোছাল। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতকে দূরে ঠেলে দিলে আওয়ামী লীগের কাছে তোপে টিকবে না বিএনপি। তাই পরবর্তী নির্বাচন ও সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে জামায়াতকে ধরে রাখতে হবে। তাই জামায়াত ক্ষুব্ধ হয় এমন কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত হবে না বিএনপি। তবে আপাতত কৌশলে জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রাখার চেষ্টা চলছে।
বিএনপির একটি অংশ যে শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে চাচ্ছে তা দলের কিছু নেতার বক্তব্য থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শুক্রবার দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন শাহবাগের মহাসমাবেশ গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আন্দোলন। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জনগণ জেগে উঠেছে। শাহবাগের আন্দোলনে জনগণের বিজয় হবে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান শাহবাগের আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, আমরা সেখানে যোগদানের ব্যাপারে আমন্ত্রণ পাইনি তাই যাইনি। এর আগে সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন জামায়াতের ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়া ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের দাবির সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। তবে শুক্রবার শাহবাগের আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপির অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি অভিযোগ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি ইস্যু ধামাচাপা দিতে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে ফেরাতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের নামে নাটক চলছে। আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সরকারের ঈমান আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
উল্লেখ্য, ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের পর বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। দিন যত যাচ্ছে এ আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের অংশগ্রহণ ততই বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কয়েক লাখ লোক প্রতিদিন সেখানে জড়ো হচ্ছে। কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরে যাবে না বলেও শপথ গ্রহণ করে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে চরম অস্বস্তি বোধ করে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বিএনপি নেতাকর্মীরা বিব্রত হয়। এ কারণে দলের একটি অংশ শাহবাগের আন্দোলনে শরিক হওয়ার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু জামায়াতের ব্যাংক ভোট হারাতে চায় না বলে বিএনপি হাইকমান্ড এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হওয়া থেকে দূরে থাকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠের প্রশ্নের জবাবে বলেন, শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তরুণরা অরাজনৈতিকভাবে শাহবাগে যে আন্দোলন করছে তা ঠিকই আছে। তবে এ আন্দোলনে আরও ইস্যু যেমন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করার বিষয়টিও থাকা দরকার। শাহবাগের আন্দোলনে সব রাজনৈতিক দল গেলেও বিএনপি কেন যাচ্ছে না জানতে চাওয়া হলে এটা তরুণদের আন্দোলন, এটা কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। তাই বিএনপি শাহবাগের আন্দোলনে যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার বলেন, আমি ঢাকার বাইরে আছি। শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে আমার কারও সঙ্গে কথা হয়নি। তাই এ ব্যাপারে আমি কোন মন্তব্য করব না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, শাহবাগের আন্দোলনের ব্যাপারে দলীয় বক্তব্য দেবেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।
এ ব্যাপারে দলের সর্বশেষ অবস্থান জানার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মোবাইল ফোনে বার বার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সংক্ষুব্ধ তরুণদের শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে আমি একমত। তিনি বলেন, ’৯৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল থেকে যুগোশ্লাভিয়া ও লাইব্রেরিয়াসহ যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। কিন্তু বাংলাদেশে সেভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। এ কারণেই যে যার খেয়াল-খুশিমতো রায় দিচ্ছেন। কাউকে দেয়া হচ্ছে যাবজ্জীবন দণ্ড আবার কাউকে দেয়া হচ্ছে ফাঁসি। এ কারণে একদিকে তরুণরা ক্ষুব্ধ হয়ে শাহবাগে আন্দোলন করছে অন্যদিকে আরেকটি অংশও রায় মেনে নিচ্ছে না। এর ফলে এ বিচার নিয়ে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। এ কারণেই বলছি বিচারের স্বচ্ছতার প্রশ্নে এ ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিয়ে জাতি সংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা শনিবার বিএনপির সমাবেশে বলেছেন, শাহবাগের আন্দোলনে অংশ নেয়া তরুণদের দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আবেগের প্রতি আমরা সম্মান করি। তবে একই সঙ্গে তাদের বলব সরকারের দুর্নীতি, হত্যা, গুম-খুনসহ একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলুন। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

No comments

Powered by Blogger.