সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড ॥ পুরস্কার ঘোষিত আসামি নিরাপত্তাকর্মী এনামুল গ্রেফতার

আজ বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যার প্রথম বর্ষ। বহুল আলোচিত এ সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকা- মামলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত সন্দেহভাজন সেই অন্যতম প্রধান আসামি নিরাপত্তা কর্মী এনামুল হক ওরফে আমিনুল ওরফে কলিম উদ্দিন ওরফে হুমায়ুনকে আটক করেছে র‌্যাব।
হত্যাকা-ের বিষয়টি তার অজানা। সে পেশাদার চোর হওয়ায় চুরি করে আটক হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সব সময়ই ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নিত। সাগর-রুনী যে বাড়িতে খুন হয়েছে সেই বাড়িতেই এনামুল ভুয়া নাম-ঠিকানায় চাকরি নিয়েছিল। এ নিয়ে সাংবাদিক দম্পতি খুনের মামলায় ৯ জন আটক হল। এখন পর্যন্ত তদন্তে আটককৃত সন্দেহভাজন আসামিদের সাংবাদিক দম্পতি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনের ডিএনএ টেস্টের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজনের ডিএনএ টেস্টের ফল এসেছে। ফলে হত্যাকা-ে তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। এনামুলেরও ডিএনএ টেস্ট করা হবে। এদিকে সাংবাদিক দম্পতি খুনের আসল মোটিভ ও রহস্য উদ্ধারে অনুসন্ধানের দায়িত্ব সাংবাদিকদেরই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিকরা।
শনিবার ভোর ৫টার দিকে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া রেলস্টেশন থেকে বহুল আলোচিত সেই এনামুলকে আটক করে র‌্যাব। এদিনই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এনামুলকে ঢাকার উত্তরায় র‌্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন র‌্যাব মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল মজিবুর রহমান, গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহ্সান, আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান ও সহকারী পরিচালক ক্যাপ্টেন অভিষেক আহমেদ।
র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতের কোন এক সময় রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানাধীন পশ্চিম রাজাবাজারের শাহজালাল প্রপার্টিজের নির্মিত রশিদ লজের ৫৮/এ/২ নম্বর ৬ তলা বাড়ির চতুর্থ তলার এ-৪ নম্বর ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন বেসরকারী মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সরোয়ার হোসেন সাগর ও তাঁর স্ত্রী বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনী।
মামলাটি বর্তমানে র‌্যাব তদন্ত করছে। সাগর-রুনীর একমাত্র ছেলে মাহিন সরোয়ার মেঘ ও আটককৃত সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এনামুলকে আটক করা হয়। এনামুল আত্মগোপন করতে শ্রীমঙ্গলে যাচ্ছিল। তখন এনামুলকে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া রেলস্টেশন থেকে আটক করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্তে আটককৃতদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনুসন্ধান ও তদন্ত অব্যাহত আছে।
র‌্যাব জানায়, সাগর-রুনীর একমাত্র সন্তান ছেলে মেঘকে কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মামলাটির রহস্য উদঘাটনে সন্দেহভাজন ১৬ জনের ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের ডিএনএ টেস্টের ফল র‌্যাবের কাছে এসেছে। সেই সূত্রধরে এনামুলকে আটক করা হয়। এনামুল আত্মগোপনে থেকে রাজধানীতে একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি করেছে। এদিকে র‌্যাব এনামুলের সন্ধান পেয়ে যাওয়ায় সে সুরমা ট্রেনযোগে শুক্রবার রাতে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। র‌্যাবের গোয়েন্দারা তার পিছু নিলে সে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে পড়ে। এখানেই র‌্যাব-৯-এর সদস্যদের সহযোগিতায় এনামুলকে আটক করা হয়।
এনামুল জানায়, ঘটনার দিন গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টায় সিকিউরিটি গার্ড পলাশের কাছ থেকে সে দায়িত্ব বুঝে নেয়। রাত ১০টা পর্যন্ত ডিউটি করে। যেদিন রাতে সাগর-রুনী খুন হন, সেইদিন রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পলাশের ডিউটি ছিল। ভোর ৬টায় পলাশের কাছ থেকে সে দায়িত্ব বুঝে নেয়।
ওইদিনই সকাল ৯টায় এনামুলকে শেরেবাংলানগর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রাত্র ১০টায় আটককৃতদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ১২টায় আবার শেরেবাংলানগর থানায় দিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। সাগরের ভাই ছাড়া তাদের ৯ দিন থানার একটি রুমে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে আটক রাখা হয়। পরে সবাইকে গাড়িতে করে আবার সাগর-রুনীদের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আবার ওই বাড়িতে ডিউটি শুরু করে। সাগর-রুনী খুন হওয়ার ১০/১২ দিন পর বেতন পাওয়ার পর এনামুল পালিয়ে শেরে-এ-খোদা কোম্পানি পরিবর্তন করে ফার্মগেটের রয়েল সিকিউরিটি কোম্পানিতে যোগদান করে। কোম্পানির পক্ষ থেকে বিভিন্ন বাসা বাড়ি বা অফিস বিল্ডিং এ ডিউটি করত এবং দিনের বেলা রয়েল সিকিউরিটির গ্রীন রোডস্থ ব্যারাকে থাকত। রাতে ডিউটি না থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে মসজিদ বা সিনেমা হলে ঘুমাত। শনিবার ভোরে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত এনামুল রয়েল সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি করেছে। চুরি করে ধরা না পড়তেই এনামুল সব সময়ই ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নিত।
র‌্যাব আরও জানায়, সাগর-রুনী হত্যা মামলার তদন্তে এ পর্যন্ত ১২৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ১৬ জন ব্যক্তির ডিএনএ টেস্টের নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজনের ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট এসেছে। তাতে হত্যাকা-ের মোটিভ বা হত্যাকারীদের সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ৮ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন, রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল, সন্দেহভাজন ডাকাত রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও মোহাম্মদ সাঈদ। আটককৃতদের মধ্যে ৫ জনই চিকিৎসক নেতা ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই হত্যা মামলার আসামি। এরা হচ্ছেন, ডা. নিতাইয়ের গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুণ, পেশাদার ডাকাত রফিক, বকুল, মিন্টু ও সাঈদ।
এদিকে শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) চত্বরে সাগর-রুনীর পরিবার ও শুভাকাক্সক্ষীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত ‘সাগর-রুনীর জন্য আমরা’ শীর্ষক আলোচনাসভায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের প্রকৃত মোটিভ ও রহস্য উদ্ধার করতে অনুসন্ধানের দায়িত্ব সাংবাদিকদেরই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। বেলা ১১টা থেকে শুরু হওয়া ওই আলোচনাসভায় অংশ নেন বেসরকারী বৈশাখী টেলিভিশেনের সি ই ও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেন, আপনারা যারা সাগর-রুনীর হত্যাকা- নিয়ে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন করতে চান, তারা সাগর সরোয়ারের ‘সেই কর্নেলকে খুঁজছি’ বইটি পড়ুন। যে দুটি চিঠি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উদ্ধার করেছিল, সেই চিঠিগুলো কোথায় তার খোঁজ নিন। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই হত্যাকা-ের পেছনে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। এর মূল অনেক দূরে।

No comments

Powered by Blogger.