ডিজিটাল আকাঙ্ৰার এই যুগে এমন বর্বর গোষ্ঠী দাঙ্গা- শেষ কোথায়?- আধিপত্যের লড়াইয়ে মানবিক মূল্যবোধ পদদলিত কেরানীগঞ্জে, সিরাজদিখানে

 ঠিক যেন আদিম বুনো সত্তায় জেগে ওঠা গোষ্ঠী সংঘর্ষ। ডিজিটাল বাংলাদেশের আকাঙ্ৰার সমকালীন প্রবাহে এ যুগে এ দৃশ্য বিস্ময়কর, অবাক কাণ্ড। দু'টি গ্রামবাসীর সংঘর্ষে সামাজিক রীতি নীতি বিশ্বাস সহিষ্ণুতা সৌজন্য আর মূল্যবোধের ক্রমাবনমন আরেকবার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
অবিশ্বাস্য হলেও শুক্রবার ঘটনাটি ঘটেছে খোদ রাজধানীর অতি সনি্নকটে কেরানীগঞ্জ ও সিরাজদিখানে। নাৎসি বর্বরতার আদলে নয়, তবে অবশ্যই মধ্যযুগীয় কায়দায় এতে ব্যবহৃত হয়েছে রামদা, হাসুয়া, জুইত্যা, বলস্নম, গেতাও টেটা, ইট, সুড়কিসহ আদিম অস্ত্রশস্ত্র। দু'গ্রামের কয়েক হাজার লোক স্ব-স্ব এলাকার পৰে লাঠি ধরেছিল। সংঘর্ষে আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত। কয়েক দফায় সংঘর্ষ চলেছে প্রায় তিন ঘণ্টা। স্থানীয় পর্যায়ে এই সংঘর্ষের নেপথ্য কারণ হিসেবে কাজ করছে দু'টি জেলার পাশাপাশি দু'টি উপজেলার পাশর্্ববর্তী ৮/১০টি চরের নিয়ন্ত্রণ কিংবা আধিপত্য ধরে রাখা। আধিপত্যের এই লড়াইয়ে মানবিক মূল্যবোধ হয়েছে পদদলিত। আর ভাড়ায় লাঠিয়ালদের ব্যবহারের কৌশল সাময়িকভাবে হলেও জয়ী হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে গভীর রাতে কোটি টাকার বাজেট কার্যকর হয়েছে যথার্থ মাত্রায়। সামান্য মাইক্রোবাস ভাড়া করার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাশাপাশি দু'টি উপজেলার পাশর্্ববর্তী দু'টি গ্রামের বাসিন্দারা তেড়ে আসে রণাঙ্গনে। এই ঘটনা মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব, শ্রদ্ধা-ভক্তি, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, বিবেক, বিবেচনা আর মানবিকতা পদদলিত করে বুনিয়াদী সামাজিক মূল্যবোধকে দেখিয়েছে বৃদ্ধাঙ্গুলি। এলাকাভিত্তিক এই যুদ্ধে একদিকে নেতৃত্ব দেন কেরানীগঞ্জের বাবুল মাতুব্বর। অন্যদিকে সিরাজদিখানের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম সরকার। কোটি টাকা খরচের ঘোষণা দিয়ে আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন সালাম সরকার। কেরানীগঞ্জের লোকও পিছু হটবার নয়। রাজধানীর উপকণ্ঠে দিনৰণ ঘোষণা দিয়েই শুরম্ন হয় সিরাজদিখানের খাসকান্দি গ্রাম আর কেরানীগঞ্জের আব্দুলস্নাহপুর গ্রামের এই যুদ্ধ। দু'টি গ্রামের পৰে-বিপৰে অবস্থান নিয়ে আরও ১০ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। নারী পুরম্নষ ছাত্র যুবক কিশোর কেউই শেষ পর্যনত্ম ঘরে থাকেনি। নারীরা পর্যনত্ম দৌড়ে গেছে বাঁশের লাঠি হাতে। জনগুরম্নত্বপূর্ণ ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অচল হয়ে পড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা। লেগে যায় দুঃসাধ্য অতিক্রম্য যানজট। এতে দেশের দৰিণাঞ্চলের হাজার-হাজার যাত্রীকে পোহাতে হয় ভোগানত্মি। টানা তিনদিনের প্রস্তুতির আগাম খবর ও আলামত পাওয়ার পরও পুলিশ কার্যকর কোন প্রতিরোধ করতে পারেনি। সমালোচকদের বক্তব্য, যেখানে সরকারের স্থানীয় প্রশাসন মাইক্রোবাস ভাড়ার দর কষাকষির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন ঘণ্টা ধরে কয়েক দফায় চলমান সংঘর্ষ থামাতে পারেনি। সেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রম্নতি কতটা কার্যকর হবে-সরকারকে তা আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। কেবল কথার কথা দিয়ে হবে না। সরকার পরিচালনা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় দৰতা দেখাতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে হোক আর জাতীয় পর্যায়ে হোক অপ্রীতিকর অনাকাঙ্ৰিত সকল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো সামথর্্য সরকারকে দেখাতে হবে।
সমাজ বিশেস্নষকদের দৃষ্টিতে ৰমতা ও আধিপত্যের লড়াইয়ে ব্যক্তির পাশবিক উন্মাদনা এই ঘটনার জন্ম দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, ৰমতা জাহির করার প্রবণতা থেকেই ব্যক্তির বিবেকবোধ লোপ পায় এবং জেগে ওঠে আদিম বুনো সত্তা। এখনও যারা সামাজিক মূল্যবোধের চিনত্মা করেন তারা শুক্রবারের কেরানীগঞ্জ এবং সিরাজদিখানের তুচ্ছ ঘটনায় কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষে রীতিমতো হতবাক। তাদের প্রশ্ন, মানুষের সহিষ্ণুতা বোধ এত নিচে নেমে গেল কিভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সমাজতাত্তি্বক কিংবা স্থানীয় সুধীজনের কাছে পাওয়া গেছে নানান বিশেস্নষণ। অনেকে রাষ্ট্র সরকারের কিঞ্চিত সমালোচনা করেও বলেছেন, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে। অথচ সরকারের স্থানীয় প্রশাসন মাইক্রোবাস ভাড়ার দর কষাকষির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন ঘণ্টা ধরে কয়েক দফায় চলমান সংঘর্ষ থামাতে পারেনি। এমনকি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বড় কর্তা ঘটনায় কিছুটা রঙ লাগিয়ে বলেছেন, 'ঠিক যেন পলাশীর যুদ্ধ।' স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বড় কর্তার এমন বক্তব্য খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার পর সমালোচকদের অনেকেই বলেছেন, 'কলির কাল ছাগলে চাটে বাঘের গাল।' খোদ পুলিশ প্রশাসনের সামনে তিন ঘণ্টার এই সংঘর্ষে পুলিশের ভূমিকা এবং বক্তব্য ছাগলের 'গ্রাসে' বাঘ বলিদানের কথাই বলছে। অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতির নিম্নমুখী প্রবণতার ফসল এই ঘটনা। প্রচলিত সমাজ বাসত্মবতায় এখন গুণীজনকে সম্মানসমীহ করার পরিবর্তে মানুষ বেশিরভাগ ৰেত্রেই অস্ত্র ও ৰমতাকে ভয় পায়। আত্মরৰার শঙ্কায় তারা প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে না। জনপ্রিয়তা তৈরিতে অর্থের জোর এখন নৈতিক মূল্যবোধের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রলুব্ধ করা যায়। তাছাড় হত্যা, খুন, লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে মানুষকে ব্যবহারের এ দেশীয় সংস্কৃতি এখন আর নতুন কিছু নয়, অনেক পুরনো।
সংৰেপে ঘটনার সূত্রপাত এবং রণাঙ্গন পর্যনত্ম পেঁৗছানোর ঘটনা পরিক্রমা শুনলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় যে কেউ হতাশ হবেন। বুধবার সকালে সিরাজদিখানের খাসকান্দি গ্রামের বাসিন্দা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম সরকারের ভাতিজা হাশেম এবং আবুল তাদের পাশর্্ববর্তী গ্রাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলার আওতাভুক্ত আব্দুলস্নাহপুর বাজারে যায় মাইক্রোবাস ভাড়া করতে। আব্দুলস্নাহপুর বাজারে মাইক্রোবাস ভাড়া স্ট্যান্ডে সব সময় ২৫/৩০ গাড়ি ভাড়ায় যাওয়ার জন্য অপেৰমাণ থাকে। সালাম সরকারের ভাতিজাদের কাছে একই মাইক্রোবাসের চালক বাবুল ভাড়া বেশি চাইলে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। সালাম সরকারের ভাতিজাদের সঙ্গে এমন তর্কাতর্কির কারণে বুধবার দুপুরেই আব্দুলস্নাহপুর বাজারে সালাম সরকারের ভাতিজারা ২০/২৫ জনের একটি গ্রম্নপ আব্দুলস্নাহপুর বাজারে মহড়া দিতে যায়। এসময় আব্দুলস্নাহপুর বাজারের মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডের সব মাইক্রোচালক মিলে সালাম সরকারের ভাতিজাদের নেতৃত্বে আসা মহড়ারত বাহিনীকে ঘিরে ধরে এবং ব্যাপক মারধর করে। ব্যাপক মারধরের মুখে সালাম সরকারের ভাতিজার বাহিনী কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে চলে যায়। কিন্তু পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে চালকরা যখন খেতে যায় সালাম সরকারের ভাতিজাদের নেতৃত্বে তখন একটি গ্রম্নপ আব্দুলস্নাহ মাইক্রো স্ট্যান্ডে গিয়ে ৮/১০টি মাইক্রোবাসে হামলা চালায় এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। এতেই ৰেপে যায় কেরানীগঞ্জের মানুষ। কেরানীগঞ্জের মানুষের কথা হচ্ছে, সিরাজদিখানের লোকজনকে ঢাকা যেতে হবে কেরানীগঞ্জের উপর দিয়েই। আবার তারা কেরানীগঞ্জে এসে লোকজন মেরে যাবে, মাইক্রোবাস ভাঙ্্চুর করবে তা সহ্য করা হবে না। বৃহস্পতিবার রাতেই কেরানীগঞ্জের স্থানীয় লোকজন সভা করে মাইক্রো ভাংচুরের জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। কেরানীগঞ্জের প্রস্তুতির তথ্য সালাম সরকারের কাছে যাওয়ার পর তিনি বৃহস্পতিবার রাতেই প্রয়োজনে কোটি টাকা খরচ করে হলেও কেরানীগঞ্জের প্রতিশোধ প্রস্তুতির বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদের জন্য চরের লোককে সংঘবদ্ধ করেন। শুক্রবার সকালে সিরাজদিখানের খাসকান্দি ও কেরানীগঞ্জের আব্দুলস্নাহপুরের জনগণ মারমুখী অবস্থান নেয়। দু'থানার পুলিশও যথারীতি সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে অবস্থান নেয়। কিন্তু সংঘর্ষে দু'পৰে বিভিন্ন চরের আরও ১০ গ্রামের মানুষের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসা দেখে থমকে যায়। প্রত্যৰদর্শীদের ভাষায়, পুলিশ 'দুলা মিয়ার' মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ এই হামলা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তাদের হয়ত প্রাণ হারাতে হবে_ এই শঙ্কায় তারা জামাইয়ের মতো ছিল। পুলিশের এমন নির্বাক আচরণে অনেকে হতবাক হলেও আসলেই নাকি র্যাব-পুলিশের কিছু করার ছিল না। কেরানীগঞ্জের আব্দুলস্নাপুর, রসুলপুর, সাকতা এবং মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের বালুর চর ইউপি, খাসকান্দি গ্রাম, পাইনার চর, মোলস্নার চর, বুলবুলিয়ার চর এলাকার লোকজন রামদা, হাসুয়া, জুইত্যা, বলস্নম, গেতাও টেটা, ইট, সুড়কীসহ আদিম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। এদের অনেককে অবশ্য দু'পৰের কর্ণধাররা আসতে বাধ্য করেছেন। চরের নিয়ন্ত্রণ দু'পৰের শীর্ষ দু'কর্ণধারের হাতে থাকার কারণে চরের মানুষগুলো সশস্ত্র অবস্থায় তেড়ে আসে। আধিপত্যের লড়াইয়ে হেরে গেলে তাদের চর ছেড়ে পালাতে হবে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েই দু'পৰের কর্ণধাররা চরের মানুষকে মাঠে নামিয়েছে। তবে দু'পৰই একটু কৌশলী অবস্থান নিয়ে প্রতিপৰকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে বলে উপস্থিত সূত্রগুলো জানিয়েছে। একপৰ ধাওয়া করলে অন্যপৰ পিছু হটে আত্মরৰামূলক অবস্থানে গিয়ে নিজেরা দাঁড়াত। একইভাবে অন্যপৰ ধাওয়া করলে এবার প্রতিপৰ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে হামলার প্রস্তুতির শো'ডাউন করেছে। ফলে প্রাণহানিকর সংঘর্ষ ঘটেনি। তবে দু'গ্রম্নপ মুখোমুখি হলে যে কোন সময় অসংখ্য প্রাণহানিকর সংঘর্ষ ঘটতে পারত বলে প্রত্যৰদর্শীদের ধারণা। দু'পৰে সংঘর্ষে নেমে আসা জনতার সংখ্যা কমপৰে ৫ হাজার, তবে মতানত্মরে কেউ কেউ বলেছেন দু'পৰে সাংঘর্ষিক প্রস্তুতি নিয়ে উপস্থিত লোকবল কমপৰে ১০ থেকে ১৫ হাজার। মাঝে মধ্যেই কেরানীগঞ্জ এবং সিরাজদিখানের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন। একটি ঘটনার উত্তেজনা কেটে গেলে ক'দিন পরে আবার নতুন ঘটনা নিয়ে সূত্রপাত ঘটে স্থানীয় এই বিরোধের। বছরের পর বছর এই বিরোধ অব্যাহত থাকলেও এর কোন স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। এর আগে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

No comments

Powered by Blogger.