জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর বিবৃতি- নিজস্ব অর্থায়নে তিন বছরে পদ্মা সেতু হবে

চলতি অর্থবছরেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে। সেতুর নকশায় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। রেল ও সড়কপথ— দুটোই থাকছে সেতুতে। আগামী তিন বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হবে।
গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেওয়া বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য সাংসদেরা বারবার টেবিল চাপড়ে তাঁদের সমর্থন জানান।
আবদুল মুহিত বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পদ্মা সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এবং দক্ষিণ বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে এই সেতুর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই সেতু বাস্তবায়নের কাজ এই অর্থবছরেই শুরু করবে এবং তিন বছরেই সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্পের এই গুরুত্বটি আমাদের সব উন্নয়ন-সহযোগী মেনে নিয়েছে। এই প্রকল্পটিতে ইতিমধ্যে চীন, মালয়েশিয়া এবং পরোক্ষভাবে ভারত তাদের আগ্রহ দেখিয়েছে। আমরা মনে করি যে বর্তমানে অর্থায়নকারী উন্নয়ন-সহযোগীরা প্রকল্পটি অর্থায়নে ভবিষ্যতে রাজি হতে পারে।’
নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কিছু কাজ আমরা সম্পন্ন করেছি। অবশিষ্ট যে কাজগুলো রয়েছে, সেগুলো হলো সেতু নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগ, পর্যবেক্ষণ পরামর্শক নিয়োগ, নদীশাসনের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ, সার্ভিস এরিয়া প্রস্তুতির জন্য ঠিকাদার নিয়োগ এবং জাজিরা ও মাওয়ার জন্য অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ। এসব কাজে মোট তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা লাগবে এবং এই ব্যয়ের জন্য আমাদের অর্থ সাশ্রয় এখন থেকে চার বছরের মধ্যে করতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এই প্রকল্পটি আমাদের নিজস্ব ব্যয়ে সম্পন্ন করতে চাই। এ জন্য নিজস্ব সম্পদ থেকে মোট এক হাজার ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করতে হবে।’
পদ্মা সেতুর জন্য এই অর্থবছরে বাজেটে যে বরাদ্দ রয়েছে, তা বাড়াতে হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী তিন বছরের জন্য পদ্মা সেতুর যে প্রাক্কলিত বাজেট আছে, তা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হবে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোয় আগামী বছরগুলোর ব্যয়ের যে হিসাব দিয়েছে, তা পরিবর্তন করার উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থানটি কয়েক বছর আগে চিন্তাও করা যেত না। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে আমাদের বার্ষিক বাজেট ছিল ৯৩ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সূত্রে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬০ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। এই বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমাদের বাজেট হলো এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ সূত্রে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হলো এক কোটি ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ অসম্ভব নয়।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে ইতিমধ্যেই প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে এই ব্যয়টি হয়েছে এবং এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। দুর্নীতির যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক করেছে, সেটি হচ্ছে দুর্নীতির সম্ভাবনা নিয়ে।’
বিশ্বব্যাংককে ‘না’ বলে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করি, তাতে এই অর্থবছরেই সেতুর কাজ শুরু করার কথা। আমাদের হিসেবে বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যেই শুরু না করলে প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও এক বছর পিছিয়ে যাবে। তাই বিশ্বব্যাংক যখন গত সেপ্টেম্বরে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রত্যাবর্তন করে, তখন থেকেই আমরা ঠিক করি, জানুয়ারিতেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। আমরা দেখলাম যে বিশ্বব্যাংকের সময়সূচি এবং আমাদের সময়সূচি মিলছে না। তাই ৩১ জানুয়ারি আমরা উন্নয়ন-সহযোগীদের জানিয়ে দিই, আমরা পদ্মা সেতুর কাজ এখনই শুরু করব এবং আমরা বিশ্বব্যাংকের অপেক্ষায় থাকব না।’
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক গত বছরের ২৯ জুন পদ্মা সেতুর জন্য তাদের প্রদত্ত সহায়তা এক হাজার ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাতিল করে দেয়। তাদের এই বাতিলকরণটা যুক্তিযুক্ত ছিল না। সে জন্য আমরা বাতিল করা চুক্তি পুনর্বহালের জন্য বিশ্বব্যাংকে আবেদন করি। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত-প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদের সংযুক্ত করতে রাজি হই। বিশ্বব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে। তবে আমরা বলি, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা যে অবস্থানে ছিলাম, সেখান থেকেই আমাদের বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের তদন্ত পরামর্শক দল গত বছরের ১৪-১৬ অক্টোবরে বাংলাদেশে এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে। ১ ডিসেম্বর পরামর্শক দল দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসে এবং দুদকের সঙ্গে তদন্ত বিষয়ে এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দুদক ১৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুবিষয়ক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা করে। দুদক এফআইআরের কপি যেমন বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক দলকে প্রেরণ করে, তেমনি অর্থ মন্ত্রণালয়েও পাঠায়। পরামর্শক দল এই বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করে। দুর্নীতি দমন কমিশন পরামর্শক দলকে এসব মন্তব্যের জবাব দেয় এবং তারা যেভাবে মামলা করেছে, তার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে। আমাদের আশা ছিল, পরামর্শক দল দুদকের তদন্ত-প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট হয়েই বিশ্বব্যাংককে তাদের প্রতিবেদন দেবে। কিন্তু জানতে পারলাম, এই প্রতিবেদন জানুয়ারি মাসে দেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে হলো, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি এবং আমাদের সময়সূচির মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি। তখন আমাদের মনে হয়, বিশ্বব্যাংকের সহায়তাকে বিসর্জন দিতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জানতাম যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে অন্য যারা যৌথ অর্থায়ন চুক্তির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তাদের সঙ্গেও চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ক্ষমতা গ্রহণের পরেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের দিকে বিশেষ নজর দিই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এ কাজে আগে থেকেই লিপ্ত ছিল এবং জাপানের জাইকাও এতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। বিশ্বব্যাংকের আগ্রহ ছিল খুবই সীমিত। চারদলীয় জোটের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে তারা বাংলাদেশের সড়ক-সেতু নির্মাণ খাত থেকে এর আগেই তাদের হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাংকই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে এই প্রকল্পে অর্থায়নে শামিল হলো এবং বাংলাদেশের জন্য কোনো একটি প্রকল্পে এককভাবে সর্বোচ্চ সাহায্য এক হাজার ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে রাজি হলো। এ প্রকল্পে আইডিবিও শামিল হলো। এসব উন্নয়ন-সহযোগী একই সঙ্গে পদ্মা সেতু দ্রুত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে এবং আমাদের অনেক আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। এর ফলে সবার মনে আশা জাগে যে পদ্মা সেতু ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মধ্যভাগেই বাস্তবায়িত হবে এবং সারা দেশে এ ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে একদিকে আমরা যেমন বদ্ধপরিকর, তেমনি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করব না। আমি দুদকের তদন্তকাজে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সম্পৃক্তিও চাই। বিশ্বব্যাংক আমাদের অনুরোধ রেখেছে এবং বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এতে অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো প্রভাব পড়বে না এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কার্যক্রমে তারা সম্পৃক্ত থাকবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলতে চাই, প্রথমত, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোনো দুর্নীতি হয়নি। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির সম্ভাবনা নিয়ে যেসব কথা উঠছে, এর প্রতিটি বিষয়ই আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছে এবং করছে। আমাদের লক্ষ্য হলো, এই প্রকল্পে যেখানে আমাদের দেশের সব মানুষ আগ্রহান্বিত ও নিবেদিত, সেখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি হতে আমরা দেব না। পদ্মা সেতুতে উন্নয়ন-সহযোগীদের অর্থায়ন আর নেই। কিন্তু তারা যেসব দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথা বলছে, সেগুলো আমরা তদন্ত করছি এবং তদন্ত চূড়ান্ত করে তার প্রতিকার করব।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এই মহান সংসদে ঘোষণা করছি, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন আমরা এই অর্থবছরেই শুরু করছি। আমরা সারা জাতিকে নিশ্চিত করতে চাই যে এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি চলবে না।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কাছে আমার আহ্বান হলো, আপনারা সাবধান হন। আপনাদের নিস্তার নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নে যাঁরা নিযুক্ত আছেন এবং ভবিষ্যতে যাঁরা নিযুক্ত হবেন, তাঁদের সবার কাছে আমার মিনতি, আপনারা এই জাতির একটি গর্বের কাজে আপনাদের দক্ষতা ও সামর্থ্যের সর্বোচ্চ মান এবং আপনাদের উন্নত মূল্যবোধ নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাবেন।’
সবশেষে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব-সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নেন কামাল আহমেদ মজুমদার, এ বি এম আবুল কাশেম, শহীদুজ্জামান সরকার ও সাধনা হালদার। এরপর সংসদের অধিবেশন আজ বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.