চেতনার স্ফুলিঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে রাজনীতির হিসেব-নিকেশ!

প্রতিদিন টক অব দ্য কান্ট্রি ‘শাহবাগে স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বর! চেতনায় জাগ্রত তারুণ্যের রক্তে জ্বলে ওঠা আগুনে আবার একাত্তরের মতোই জেগে উঠেছে বাঙালী।
প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে উচ্চারিত তারুণ্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ জাগিয়ে তুলেছে পুরো বাংলাদেশকে। নেই কোন রাজনীতি বা দলবাজি, নেই দলপতি, কেবলই নতুন প্রজন্মের একাত্মতা আর মহাসমুদ্রের গর্জনে রাজধানী তো বটেই, ঢাকার বাইরে দেশের প্রতিটি শহরে, মফস্বলে আজ নব উদ্যোমে জেগে উঠেছে তারুণ্য। লক্ষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে একাত্তরের মতোই গর্জে উঠা তরুণরা আজ সমস্বরে উচ্চারণ করছে- ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।’ এ যেন জাতির নবজাগরণ। এই যৌবনজলতরঙ্গ থামবার নয়, থামানো যাবে না। বাংলাদেশের হৃদয়ের কথা তাদের কণ্ঠে। শুক্রবারের মহাসমুদ্রের মহাগর্জন প্রত্যক্ষ করার পর বাঙালীর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সেই বিখ্যাত পঙক্তিখানি- ‘এই যৌবনজলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?’
শুধু রাজধানীই নয়, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখেই একটি নাম- সারাদেশকে কাঁপিয়ে তোলা স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বর। নানা পথ দিয়ে আসা নানা মতের মানুষের পোশাকি পরিচয় দৃশ্যমান থাকলেও, রাতের আঁধার ফুঁড়ে দ্রোহের আগুন বুকে জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে এক অন্যরকম সময় কাটাচ্ছে শাহবাগ। সকলের এক ধ্যান রাজাকারের ফাঁসি চাই। আর নতুন প্রজন্মের বুকে জ্বলে ওঠা আগুন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। কোন রাজনৈতিক সমর্থন, নেতৃত্ব বা দলপতি ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লাখ লাখ মানুষের মহাসমুদ্র রচনা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে একাত্তরের চেতনায় জাগ্রত দেশের তরুণ সমাজ। পাল্টে দিয়েছে রাজনীতির সকল হিসেব নিকাশ।
এর আগের তিন দিনের সমাবেশ শেষে শুক্রবার আহ্বান করা হয় মহাসমাবেশের। বিকেল ৩টায় সবাইকে এই সমাবেশে ডাকা হয়। কে ডেকেছে, তার নামই বা কি কেউ জানে না। মহাসমাবেশ আহ্বানকারীদের কোন দল নেই, পকেটে টাকাও নেই। তারা টেলিভিশনের পরিচিত কোন মুখ নয়, বড় নেতা বা তারকাও নয়। তারা কেবল ফেসবুকে, ব্লগে লিখে ডাক দিয়েছে এই মহাসমাবেশের। রাজনীতির চিরচেনা দৃশ্য টাকা দিয়ে বা ট্রাক ভাড়া করে আনতে হয়নি কাউকে। সব মানুষের শুধু জানার বিষয়টি ছিল মহাসমাবেশে যেতে হবে, জানাতে হবে একাত্মতা। তাই বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো লাখ লাখ মানুষ মহাসমাবেশে এসেছিলেন নিজের গরজে। স্বাধীনতার পর এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত মহাসমুদ্রের মহাগর্জন অতীতে কখনও দেখেনি দেশের মানুষ। কোন রাজনীতি নয় তীব্র ওই জনস্রোত ও গণজাগরণ ঐক্য মঞ্চ থেকে সকলের কণ্ঠে ছিল একই আওয়াজÑ চাই রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ। শাহবাগের উজ্জীবিত তারুণ্য শুধু পুরো দেশকেই নাড়িয়ে দেয়নি, জাগ্রত করে তুলেছে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালীদেরও। আর নতুন প্রজন্মের এই নবজাগরণে বিদেশীদের মাঝেও সৃষ্টি করেছে গভীর আগ্রহের। বাংলাদেশে গবেষণার কাজে আসা ব্রিটিশ নাগরিক জন স্টিভেন শুক্রবারের শাহবাগে এসে এ দেশের নতুন প্রজন্মের তারুণ্যের এই জোয়ার দেখে অভিভূত। তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল- বাংলাদেশের তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর নিজের দেশসহ পশ্চিমা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মাঝে এত বেশি রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যায় না। তাঁর মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। তাই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদেরও অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
তারুণ্যের রক্তে জ্বেলে ওঠা আগুন আর শাহবাগে গর্জে ওঠা আরেক একাত্তরের মিছিল দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন লেখক, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল। একাত্তরের চেতনায় জাগ্রত বিবেকের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখার সময় আবেগাপ্লুত জাফর ইকবাল বলেন, আমার জীবনে এত আনন্দের দিন আর কখনও আসেনি। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আজকের ২০১৩ সাল একাত্তর সালে রূপান্তরিত হয়েছে। আজকের এই দিনে শুধু আমি আনন্দিত নই, শেষ শীতের বিকেলের এই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন আমাদের ৩০ লাখ শহীদ, তাকিয়ে আছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ওপর থেকে তাঁরা এই সমাবেশ দেখছেন, আজ তাঁদের মুখেও হাসি। আমাদের প্রত্যাশার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ তোমরা আবার ফিরিয়ে এনেছ। নতুন প্রজন্ম তোমাদের ধন্যবাদ, অভিনন্দন।
শুধু ড. জাফর ইকবালই নন, গত ৬ দিন ধরেই গণ-মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হচ্ছেন আন্দোলনকারী নতুন প্রজন্মের সাহসী সন্তানরা। নতুন প্রজন্মের স্পর্ধিত উচ্চারণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একাত্তরের মতোই উজ্জীবিত রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। প্রতিবাদ আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে এবং নানাভাবে ক্লান্তিহীনভাবে আন্দোলনরত তরুণদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। শনিবার আন্দোলনরত নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু পানি ও জুস এনে বিতরণকালে মুক্তিযোদ্ধা শরাফত আলীর প্রতিক্রিয়া ছিল- ‘আমরা একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলাম একটি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য। আজ শাহবাগে দেশের তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধ করছে দেশকে রাজাকারমুক্ত ও বাঙালী জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে। এদের যুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করতে পেরে আমি আনন্দিত, ধন্য।
পাল্টে গেছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ॥ তরুণ প্রজন্মের চেতনার বিস্ফোরণে পাল্টে গেছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে অনেক আগে থেকেই চলছিল দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে স্বাধীনতাবিরোধীরা ছিটিয়েছে শত শত কোটি টাকা। দেশের রাজপথে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের সহিংস তা-ব, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশ হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও প্রত্যক্ষ করে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল দেশের মানুষ। স্বাধীনতাবিরোধীরা ভেবেছিল সহিংস পথেই তারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করবে। কিন্তু মৃত্যুদ- না দিয়ে একাত্তরের কুখ্যাত ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দ-ের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা নতুন প্রজন্মের দ্রোহের আগুনে পাল্টে গেছে সেই পরিস্থিতি।
নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনে রাজনীতি না থাকলেও তাদের বুকে জ্বলে ওঠা আগুন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ডে। কোটি টাকা খরচ আর ক্লান্তিহীন প্রচার চালিয়েও তারা নিজেদের দলীয় কর্মসূচীতে নামাতে পারেনি জনতার ঢেউ। অথচ বিনা খরচে, প্রচার ছাড়াই জনসমুদ্রের মহাগর্জন দেখে স্বস্তিতে নেই দেশের তারকা রাজনীতিকরা। রাজনৈতিক কোন সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই জনতার উম্মিলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া দেখে নিজেদের মধ্যেও লাভ-লোকসানের হিসেব কষতে বসেছেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একাত্তরের মতোই নতুন প্রজন্ম কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার। কাদের মোল্লার লঘুদ-ের রায়কে ঘিরে গড়ে ওঠা জনজোয়ারে অস্বস্তিতে পড়েছে তারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার নিয়ে তরুণ প্রজন্মের বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে সেই তরুণ প্রজন্মই এখন কাদের মোল্লার রায় নিয়ে সন্দেহের চোখে দেখছে। তাই সারাদেশে গড়ে ওঠা এ গণজাগরণ কোনভাবেই যাতে সরকারের বিরুদ্ধে না যায়, তা সুচারুভাবে খেয়াল রাখছে সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাদের মোল্লার রায় মানুষের প্রত্যাশিত হয়নি। একটি রায়েই এমন বিস্ফোরণ ঘটেছে। সামনে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ আরও কয়েকটি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর সরকারের কোন কর্তৃত্ব বা হাত নেই। যদি অন্য কোন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় জনগণের কাক্সিক্ষত না হয়, তা হলে দেশের পরিস্থিতি কী হবে, সেভেবে সরকারের হাইকমান্ডও উদ্বিগ্ন।
তবে তরুণ প্রজন্মের এমন গণজাগরণে অনেকটাই বেকায়দায় পড়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির হাইকমান্ড কল্পনাও করতে পারেনি কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে পুরো বাংলাদেশই এমন ফুঁসে উঠবে। এতদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ এবং কারাগারে আটক রাজাকার শিরোমণিদের মুক্তির দাবি করে আসছিলেন দলটির প্রধান খালেদা জিয়া। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী পরিচালিত সহিংস তা-বেও প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে আসছিল দলটি।
এমনকি কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে সৃষ্ট জনজোয়ার নিয়েও প্রকাশ্য কটাক্ষ করেছেন বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে গড়ে ওঠা আন্দোলন নিয়ে কটাক্ষ করে মহাসমাবেশের মাত্র এক দিন আগে দলটির দুই সিনিয়র নেতা এমকে আনোয়ার ও তরিকুল ইসলাম। কিন্তু শুক্রবারের জনতার ঢেউ দেখে এখন সুর পাল্টে ফেলেছেন দলটির নেতারা। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মহাগর্জন উঠলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তা পাশ কাটিয়ে বলেন, এটি গণতন্ত্রের আন্দোলন! এ আন্দোলন ঘিরে জেগে উঠেছে দেশের মানুষ। শাহবাগের আন্দোলনে জনগণের বিজয় হবেই। জানা গেছে, সারাদেশে গর্জে ওঠা একাত্তরের চেতনায় জেগে ওঠা দেশের তরুণ প্রজন্মের দাবির মুখে বিএনপির শুভাকাক্সিক্ষরা দলের স্বার্থেই দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন।
তবে সারাদেশেই তারুণ্যের রক্তে জ্বলে ওঠা আগুনে মহাবিপদে পড়েছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির চক্র। অনেকদিন ধরেই জঙ্গী স্টাইলে সারাদেশে সহিংস তা-ব চালিয়ে, মানুষ হত্যা করে তাদের শক্তির কথা দেশবাসীকে জানান দিচ্ছিল এই অন্ধকারের শক্তিটি। নির্বিচারে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা, গুলি চালিয়ে সারাদেশে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে তারা ভেবেছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে সহিংসতার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা সম্ভব হবে। এমনকি তারা প্রকাশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে হুমকি এবং দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধাবারও ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে লঘুদ-ের রায় ঘোষণার পর জ্বলে ওঠা বিক্ষোভের আগুনে অনেকটাই গর্তে ঢোকার অবস্থা হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটির।
তারুণ্যের মহাসমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং রাজাকার-আলবদরদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা এবং দৃপ্ত শপথ গ্রহণের দৃশ্য দেখে জামায়াতের হাইকমান্ড দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কাঁপুনি উঠেছে রাজপথে সহিংস তা-বে লিপ্ত জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের মনেও। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা উজ্জীবিত তারুণ্যের বিক্ষোভের মাঝেও শনিবার বৃহত্তর চট্টগ্রামে হরতাল দিয়েছিল তারা। কিন্তু শাহবাগের আন্দোলনের অগ্নিষ্ফুলিঙ্গ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় চট্টগ্রামের রাজপথে নামতেই পারেনি জামায়াত-শিবির। রাজপথের সর্বত্র জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘোষণায় ঘর থেকেই বের হতে পারেনি এসব ক্যাডাররা। এতদিন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের হিংস্র জামায়াতের বিষাক্ত থাবায় দেশ কলুষিত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এবারই প্রথম অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের এ দলটিকে। তরুণ প্রজন্মের লাখো সমাবেশ থেকে জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষবৃক্ষ উৎপাটনের কঠোর হুঁশিয়ারিতে ভীত সন্ত্রস্ত্র দলটির ক্যাডাররা এখন আত্মগোপনের পথ খুঁজছে বলেই দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে।
ফেসবুক থেকে রাজপথ ॥ নতুন প্রজন্মের এই বাঁধাভাঙ্গা জোয়ারের সূত্রপাত গত ৫ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর থেকে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও একজন হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো না, এই রায় মেনে নিতে পারেনি তরুণ প্রজন্ম। রায় ঘোষণার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা ব্লকসাইটগুলোতেও ব্লগারদের পোস্টগুলো এই রায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে।
‘এমন রায়ে আমরা মর্মাহত, ব্যথিত ও লজ্জিত। আশা করেছিলাম, কাদের মোল্লার ফাঁসি হবে। তা হয়নি। এখন ঘরে বসে থাকতে পারছি না। রাস্তায় বের হচ্ছি। তোমরাও প্রতিবাদ জানাতে এখনই ঘরের বাইরে চলে এসো। জাতীয় জাদুঘরের সামনে সবাই একত্রিত হও। শুধু ব্লগে আর কি বোর্ডে হাত রেখে প্রতিবাদ করার সময় পার হয়ে গেছে।’- গত মঙ্গলবার মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিটি নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ডা. ইমরান অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই পোস্টটি লিখেই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েন।
ওইদিন বিকেলেই ডা. ইমরানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথমে অল্প কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে জড়ো হন। এর পর ওই সংগঠনের প্লাটফরমে সমাজের জনতা একত্র হয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবি জানাতে শুরু করে। ব্লগারদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর মধুর ক্যান্টিন থেকে বিক্ষোভ মিছিল ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতাকর্মীরা এসে সংহতি প্রকাশ করে। ক্রমেই ভিড় বাড়তে থাকে শাহবাগ চত্বরে। ৫০, ১০০, হাজার ছাপিয়ে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগে জনস্রোত নামে। মুহূর্তেই হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ব্লগাররা পরিণত হন ‘প্রজন্মের বাঁশিওয়ালা’য়। শাহবাগ মোড়ও ইতোমধ্যে নতুন নাম পেয়েছে ‘প্রজন্ম’ চত্বর।
সময়ের ব্যবধানে শাহবাগ থেকে ওঠা গণজোয়ারের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। কয়েক তরুণ ব্লগারের বুকে লালন করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্যানভাসের রঙ এখন ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। গণবিস্ফোরণের ঢেউয়ে উন্মাতাল এখন সারাদেশ। শাহবাগ এখন তরুণ-তরুণীদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের প্লাটফর্ম।
অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে ইয়ুথ ফর পিস এ্যান্ড ডেমোক্রেসিতে কাজ করছেন ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের প্রকাশনা সম্পাদক অমিত বিক্রম ত্রিপুরা। তিনি এ গণজোয়ার সৃষ্টির প্রাথমিক পর্বের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, মঙ্গলবার রায়ের পর পরই প্রথমে ফেসবুকে ইমরান ভাইয়ের এক স্ট্যাটাস দেখি। সেটি দেখার পর অনেক ব্লগার সেখানে ‘লাইক কমেন্টস’ করে শাহবাগে হাজির হতে অনুরোধ করেন। এরপর ব্লগাররা নিজেদের মধ্যে মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করেন। হরতালের মধ্যেই অনেক ব্লগার সেখানে হাজির হয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র সেই প্রয়াস বিশাল আকার ধারণ করে। ব্লগারদের উদ্যোগে এভাবে জনজোয়ার সৃষ্টি হবে, তা আমরা কল্পনাও করিনি। জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.