জলাভূমি সংরক্ষণ- নদী-খাল-বিল-হাওড়-বাঁওড়-পুকুর-জলাশয় আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ, জীবনের অংশ

শনিবার রাজধানীতে পালন করা হলো বিশ্ব জলাভূমি দিবস। দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী কূটনীতিক, পানি বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, লেখক-গবেষকগণ জলাভূমি সংরক্ষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছেন; নানা পরামর্শ দিয়েছেন।
জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্যÑ এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব ঘরোয়া ও বৃত্তাবদ্ধ আলোচনা-বৈঠক বৃহত্তর পরিসরে কতটা প্রভাব ফেলে, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন ও ভারসাম্য রক্ষার অংশ হিসেবেই জলাভূমির সংরক্ষণ ও উন্নয়নের চিন্তা মানুষের মাথায় আসে। ১৯৭১ সালে ইরানের কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী শহর রামসারে অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব সম্মেলনে প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব জলাভূমি দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এই দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে। বাংলাদেশেও দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, এই দিবসের মূল চেতনা আর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তব প্রতিফলন আমাদের দেশে তেমনটি দেখা যায় না। বরং নির্মম সত্য এই যে, নদী-হাওড়, বিল-ঝিল, খাল আর পুকুর-জলাশয়ে ভরা এ দেশের বুক থেকে ক্রমশ সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ব্যাপকহারে। এই রাজধানী ঢাকা শহরের বুক থেকে কত খাল-পুকুর হারিয়ে গেছে তা উদঘাটনে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে। সারাদেশের চিত্রই কমবেশি এমনটি। সেই জল থৈ থৈ নদী-পুকুর আজ ক’টি পাওয়া যাবে! গ্রামের টইটম্বুর জল টলমল খালগুলোর আজ মরণদশা। অনেক খালই ভরাট করে হয় বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে, নয়ত ধান-পাট-তরিতরকারি চাষ করা হচ্ছে। যেসব নদী খনন ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্রোতস্বিনী, নাব্য ও পরিবেশ-নন্দন করা যেত, তার অধিকাংশই আজ শ্রীহীন, পরিত্যক্তপ্রায়, হাজামজা এবং শৈবালাকীর্ণ। অধুনা আধুনিক আবাসনের নামে একশ্রেণীর ভূমিদস্যু যেভাবে বিভিন্ন জলাশয় ভরাট করে চলেছে, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। এদের নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বড় বড় হাওড়-বাঁওড় নানা সম্পদে ভরপুর। এসব হাওড়ও আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক ছোট আকারের হাওড়কে হাওড় বলে শনাক্ত করাই এখন দুষ্কর। অদূরভবিষ্যতে এগুলো হয়ত সমতল ভূমির সঙ্গে মিশে যাবে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের বিশাল ভা-ারও।
নদী-খাল-বিল-হাওড়-বাঁওড়-পুকুর-জলাশয় আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ, জীবনের অংশ। এসবের সংরক্ষণ ও উন্নয়নও তাই করতে হবে আমাদের সার্বিক স্বার্থেই। সম্প্রতি রাজধানীর হাতির ঝিলকে নবজীবন দান ও নবরূপে সজ্জিত করে সরকার জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, বিশ্ব জলাভূমি দিবসের মর্ম-চেতনার সঙ্গে তা চমৎকারভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই দৃষ্টান্তটি অনুসরণ করে আমাদের আরও বৃহত্তর পরিসরে অগ্রসর হতে হবে। সরকার হাওড় উন্নয়নের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনা কার্যকর হলে হাওড় উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া দেশের খাল-নদী, পুকুর-ঝিল এবং মিঠাপানির সব জলাশয় সংরক্ষণ ও উন্নয়নকল্পেও পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাহায্যে সরকার এ উদ্যোগটি নিতে পারে। জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে, অন্যদিকে আহরিত হবে প্রচুর মৎস্য ও জলজ সম্পদ। আর এভাবেই বিশ্ব জলাভূমি দিবসের মর্মবাণী আনুষ্ঠানিকতা ও বৃত্তাবদ্ধতার গ-ি পেরিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিভাত হবে বলে দৃঢ় আশা পোষণ করা যায়।

No comments

Powered by Blogger.