খাঁটি দুধে মিশাইছে পানি-বৈঠকী ও ধামাইল গান, গড়িয়া নৃত্য- বকুলতলায় দেশঘরের গানের আসর শুরু

 ওয়াহিদুল হক শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি তাঁর লেখা ও কর্মের মাধ্যমে দেশজ শিক্ষা ও সঙ্গীতের মতো দুটো বিষয়কে সব সময়ই জোর দিয়েছেন।
তাঁর মতে, এই দুয়ের যথাযথ পরিচয়ে, চর্চায় ও সংরক্ষণে আমাদের সংস্কৃতির কাঠামো মজবুত হয়ে উঠবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নানান ক্ষেত্রে আমাদের যেসব বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে তার জন্য আমরাই দায়ী। অনেককিছুর মতো তাঁদের (প্রান্তিক জনগোষ্ঠী) অসামান্য সঙ্গীত ভাণ্ডারের সঙ্গেও আমাদের যোগসূত্র স্থায়ী হচ্ছে না। এতে করে আমাদের প্রকৃত 'যৌথ_আমি'কে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশঘরের আমিগুলো ক্রমে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। স্বার্থদ্বন্দ্ব বাড়ছে, বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা। কিন্তু আমরা, যাঁরা সঙ্গীতের অসম্পূর্ণ ধারণার অধিকারী, তাঁরা যদি দেশগ্রামের সঙ্গীতসম্পদের প্রত্যৰ পরিচয় পাই, তাহলে স্বকীয় সংস্কৃতির পূর্ণজ্ঞান অর্জন করতে পারি। ওয়াহিদুল হকের এই বিশ্বাসকে লালন করে ছায়ানট তাঁর স্মরণে আয়োজন করেছে দু'দিনব্যাপী 'দেশঘরের গান' আসরের।
শুক্রবার চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় শুরু হয় দু'দিনব্যাপী এই দেশঘরের গানের আসর। উদ্বোধন করেন মানিকগঞ্জের গুণীশিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতী। স্বাগত ভাষণ দেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। দেশঘরের গানের আসরের উদ্বোধন করে সাইদুর রহমান বয়াতী বলেন, আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে_ এমনই লোক ছিলেন ওয়াহিদুল হক। বাংলা কৃষ্টি, আদিসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, সংস্কৃতিসহ সবই ধারণ করে রেখেছিলেন নিজের ভেতর। এজন্য তাঁকে জানাই হাজার সালাম। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে লাড়ে লাপ্পা ধাচের গান পরিবেশিত হচ্ছে। এর অর্থ আমি বিদেশী গানের বিপৰে নই। বিদেশী গান আমরা গাইব, তবে নিজেদের সংস্কৃতি রৰা করে। দেশের আসল গান, দেশঘরের গান ও আদি গানের সুর, তাল, লয়, বয়ান এসব ঠিক রাখার দিকে আমাদের বেশি নজর দিতে হবে। তারপর আমাদের বিদেশী গানের দিকে নজর দিতে হবে। উলেস্নখ্য, সাইদুর রহমান প্রায় তিন হাজার গানের রচয়িতা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গেয়ে শোনান তাঁর লেখা_ আমি গাইবো না আর কোন গান... এর কয়েকটি চয়ন।
এরপরেই শুরম্ন হয় ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান। শুরম্নতেই সম্মেলক কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা গেয়ে শোনান শাহ আব্দুল করিমের গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলাগান আর ঘাটু গান গাইতাম... গানটি। এরপর মুর্শিদী গান পরিবেশন করেন সরদার মোহাম্মদ রহমতউলস্নাহ। তিনি গেয়ে শোনান- ও-মুরশিদ পথ দেখাইয়া দাও, আমিযে পথ চিনি না সঙ্গে কইরা নাও... গানটি। হরলাল রায়ের কথা ও সুরে স্বপ্না রায় গেয়ে শোনান ভাওয়াইয়া গান_ মশা পেটগুলো তার ডাম ডিমাডিম করে... গানটি। আর নারায়ণ চন্দ্রশীল পরিবেশন করেন ঘর ভাঙবে তোর আজ না হয় কাল... গানটি। এরপরেই শুরম্ন হয় দেশঘরের বৈঠকী গান। পরিবেশন করে কুড়িগ্রামের অননত্ম কুমার দেব ও তাঁর দল।
অননত্ম কুমার বলেন, তাঁর এই বৈঠকী গান উত্তর জনপদের খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণের গান। সারাদিনের কানত্মির পর গ্রামের বিত্তবান কোন মানুষের বাহির আঙ্গিনায় সমবেত হয় এই মানুষগুলো। খোল, করতাল, ঝাঁজ ও গোপীযন্ত্র বাজিয়ে উদাস অথচ উদাত্ত কণ্ঠে সারারাত কিংবা মধ্যরাত পর্যনত্ম চলে গুরম্ন- শিষ্যের লড়াই। এই বৈঠকী গানে সমাজের কুসংস্কার, গণসচেতনতার কথা উঠে আসে চা-পানের মাধ্যমে। ধলস্না, তিসত্মা, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গাধর বিধৌত এলাকার কর্মজীবী জনগণের আশা-আকাঙ্ৰা ও ভালবাসার কথা পাওয়া যায় এই গানে বিভিন্ন রসে। তাঁদের এই বৈঠকী গানে প্রথমেই শিষ্য গেয়ে ওঠে_ গুরম্ন একলাই ছিলাম তোমার দেশে উঠায়ে আনিয়া গুরম্ন বসাইয়া কান্দাইলে যে...। এর জবাবে গুরম্ন গেয়ে ওঠে_ মন তুই করিসনে বেয়ানি ( বেইমানি), খাঁটি দুধে মিশাইছে পানি, পাঁচ আইনে বন্দী তুমি কে শোনে তোমার ঘ্যানঘ্যানানি, খাঁটি দুধে মিশাইছে পানি...। এভাবেই কথার পিঠে কথা সাজিয়ে গুরম্ন-শিষ্যের বৈঠকী গানের এই লড়াই চলে এক ঘণ্টারও উপরে। এরপরেই ধামাইল গান পরিবেশন করে সুনামগঞ্জের কৃষ্ণচন্দ্র চন্দ ও তাঁর দল। গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করে খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংগঠন ডাইরিং সাংস্কৃতিক ফোরাম। শেষে ছায়ানটের শিল্পীরা আবার পরিবেশন করে একক ও দলীয় গান। আজ দেশঘরের গানের সমাপনী অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হবে কীর্তন, জারি গান ও ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনা।

No comments

Powered by Blogger.