ভারতের দামিনী থেকে কাপাসিয়ার কিশোরী by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
দামিনী (ছদ্মনাম) মেডিক্যালের শিক্ষার্থী। দিলি্লতে বাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ভারতজুড়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও তোলপাড়। অবশেষে মৃত্যুর সঙ্গে হার মেনে প্রমাণ করে গেলেন পৈশাচিক নির্যাতনের প্রতিবাদ কিভাবে সম্ভব। বাঁচার প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু পারেননি।
পুরো ভারতবাসীকে নাড়া দিয়েছে মধ্যযুগের মতো এ বর্বর আচরণ। এমন একটি ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলায়। এ মেয়েটিও গণধর্ষণের শিকার হয়। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তবে ভারতের মতো নয়। সাধারণ মানুষকে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু ওদের মতো পারেনি। হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা আমরা ভয়ানকভাবে লক্ষ করি। এ নিয়ে দেশের ভেতর প্রতিবাদ চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে- এমনটি আশা রাখি। কিন্তু মানুষকে জাগরিত করার মতো কোনো প্রতিবাদ এখনো চোখে পড়ে না। অনেকে নির্বাক, নির্বিকার, নির্লিপ্ত। যেন কিছু বলা উচিত কিন্তু বলা যাচ্ছে না, বলতে পারছি না। রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও পেশিশক্তি।
এ রকম আবহাওয়ায় অতি সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায়। ক্ষমতাসীন এক এমপির এপিএস পরিচয়ধারী তার বাসার কাজের মেয়েকে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণের পর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে। নির্যাতনের কাজে সহায়তায় তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। কৌশলে গৃহকর্মীকে নিজ এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া। ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মেয়েটিকে তার পরিবারসহ নিজ ইউনিয়ন পরিষদে এনে লিখিত টিপসই-সংবলিত বক্তব্য সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা নির্যাতিতার বাড়িতে ঢুকে পরিবারকে কয়েকবার প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ কাজে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারের বিরুদ্ধে। যদি সত্যি হয়, সেটি হবে রক্ষক নিজেই ভক্ষকের শামিল। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টার মতো মেয়েটিকে সাংবাদিকদের সামনে আনলেই সব শেষে হয়ে গেল। সব কিছুই মিথ্যা। কী এক সভ্য সমাজে বাস করছি আমরা। আমাদের হাসি পায় যখন থানার ওসি জানান, 'এ বিষয়ে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কেউ থানায় অভিযোগ করেনি।' তিনি আরো বলেন, ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি নির্যাতনের শিকার কিশোরী ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। বাকিরা এখন পর্যন্ত নিশ্চুুপ।
মেয়েটি নিতান্ত গরিব ঘরের। নাহলে বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ কেন নেবে। আর যিনি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ক্ষমতাধর। তিনি তাঁর ক্ষমতাকে পুঁজি করে আরো কতগুলো ঘটনা ঘটিয়েছেন। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি, হয়তো আদৌ হবেন কি না সন্দেহ। কেননা তাঁর রয়েছে প্রভাব। আর আমরা সাধারণ মানুষও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ভয় পাই। নূ্যনতম প্রতিবাদের মাধ্যমে নাড়া দিতে পারি না। এ দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে মানুষের হা-হুতাশ নেই। নাহলে ভারতজুড়ে যেভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠল আমাদের দেশে তেমনটি নয় কেন। দিলি্ল ও টাঙ্গাইলের গণধর্ষণের ঘটনা কি এক নয়। অথচ দিলি্ল যেভাবে কেঁপে উঠল ঢাকা তেমনটি নয়। এখানেই তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। আমরা ভয় পাই, আমাদের স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের চেতনা থাকে না। আমরা ভাবি আমি তো শিকার নই। এ রকম মনোভাব ও ভাবনা নির্যাতনকারীকে উৎসাহিত করে। আমাদের নির্লিপ্ততা তাদের বিচার না পাওয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের বিচার না হওয়ায় একই কর্ম করার প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি করে। ওধু তাদের কেন অন্যরাও একই কাজে আগ্রহ অনুভব করে। সামাজিক অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যায়।
কখনো কখনো মনে করা হয়, কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা সামাজিক অপরাধের দৈর্ঘ্যকে লম্বা হতে না দিতে পারি। কিছু আইন প্রণয়নই সমাপ্তি নয়, যদি আইনের কার্যকর আমরা না করতে পারি। মুখে বললাম কঠোর আইন রয়েছে; কিন্তু অপরাধীদের আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে পারলাম না। সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োজনীয়তা কী? তবে এ কথা ভুল নয় যে, আমরা যদি আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারি সে ক্ষেত্রে সামাজিক অপরাধের মাত্রা কমবে। কিন্তু আমরা প্রথমেই হোঁচট খাই। যেকোনোভাবেই হোক চার্জশিট থেকে মূল আসামিদের নাম বাদ যায়। এর আগেই মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। আবার চার্জশিটভুক্ত হলেও প্রকারান্তরে শাস্তি থেকে রেহাই পায়। আমাদের বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এ কথাটি হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়ই হোক কিংবা অর্থের বিনিময়েই হোক আমরা অপরাধ করেও নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি। অন্যদিকে সামাজিক প্রক্রিয়ায় অপরাধ প্রতিরোধ জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। যদি এটি বেশি মাত্রায় কার্যকর হতো তাহলে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার তত প্রয়োজন হতো না। কিন্তু সেটি সঠিকভাবে কাজ করছে না বিধায় বিকল্প ব্যবস্থা, যার নাম শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন। কিন্তু যিনি শাস্তিই পাচ্ছেন না তিনি কী করে সংশোধন হবেন? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশে সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিবিধ আইন রয়েছে। সর্বর্শেষ পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। আইনি কাঠামোর এ ব্যর্থতার দায়ভার কে নেবে? এখন সময় এসেছে নতুনভাবে চিন্তা করার, না হলে আবারও আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যেতে হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
এ রকম আবহাওয়ায় অতি সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায়। ক্ষমতাসীন এক এমপির এপিএস পরিচয়ধারী তার বাসার কাজের মেয়েকে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণের পর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে। নির্যাতনের কাজে সহায়তায় তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। কৌশলে গৃহকর্মীকে নিজ এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া। ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মেয়েটিকে তার পরিবারসহ নিজ ইউনিয়ন পরিষদে এনে লিখিত টিপসই-সংবলিত বক্তব্য সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা নির্যাতিতার বাড়িতে ঢুকে পরিবারকে কয়েকবার প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ কাজে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারের বিরুদ্ধে। যদি সত্যি হয়, সেটি হবে রক্ষক নিজেই ভক্ষকের শামিল। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টার মতো মেয়েটিকে সাংবাদিকদের সামনে আনলেই সব শেষে হয়ে গেল। সব কিছুই মিথ্যা। কী এক সভ্য সমাজে বাস করছি আমরা। আমাদের হাসি পায় যখন থানার ওসি জানান, 'এ বিষয়ে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কেউ থানায় অভিযোগ করেনি।' তিনি আরো বলেন, ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি নির্যাতনের শিকার কিশোরী ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। বাকিরা এখন পর্যন্ত নিশ্চুুপ।
মেয়েটি নিতান্ত গরিব ঘরের। নাহলে বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ কেন নেবে। আর যিনি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ক্ষমতাধর। তিনি তাঁর ক্ষমতাকে পুঁজি করে আরো কতগুলো ঘটনা ঘটিয়েছেন। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি, হয়তো আদৌ হবেন কি না সন্দেহ। কেননা তাঁর রয়েছে প্রভাব। আর আমরা সাধারণ মানুষও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ভয় পাই। নূ্যনতম প্রতিবাদের মাধ্যমে নাড়া দিতে পারি না। এ দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে মানুষের হা-হুতাশ নেই। নাহলে ভারতজুড়ে যেভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠল আমাদের দেশে তেমনটি নয় কেন। দিলি্ল ও টাঙ্গাইলের গণধর্ষণের ঘটনা কি এক নয়। অথচ দিলি্ল যেভাবে কেঁপে উঠল ঢাকা তেমনটি নয়। এখানেই তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। আমরা ভয় পাই, আমাদের স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের চেতনা থাকে না। আমরা ভাবি আমি তো শিকার নই। এ রকম মনোভাব ও ভাবনা নির্যাতনকারীকে উৎসাহিত করে। আমাদের নির্লিপ্ততা তাদের বিচার না পাওয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের বিচার না হওয়ায় একই কর্ম করার প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি করে। ওধু তাদের কেন অন্যরাও একই কাজে আগ্রহ অনুভব করে। সামাজিক অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যায়।
কখনো কখনো মনে করা হয়, কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা সামাজিক অপরাধের দৈর্ঘ্যকে লম্বা হতে না দিতে পারি। কিছু আইন প্রণয়নই সমাপ্তি নয়, যদি আইনের কার্যকর আমরা না করতে পারি। মুখে বললাম কঠোর আইন রয়েছে; কিন্তু অপরাধীদের আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে পারলাম না। সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োজনীয়তা কী? তবে এ কথা ভুল নয় যে, আমরা যদি আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারি সে ক্ষেত্রে সামাজিক অপরাধের মাত্রা কমবে। কিন্তু আমরা প্রথমেই হোঁচট খাই। যেকোনোভাবেই হোক চার্জশিট থেকে মূল আসামিদের নাম বাদ যায়। এর আগেই মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। আবার চার্জশিটভুক্ত হলেও প্রকারান্তরে শাস্তি থেকে রেহাই পায়। আমাদের বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এ কথাটি হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়ই হোক কিংবা অর্থের বিনিময়েই হোক আমরা অপরাধ করেও নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি। অন্যদিকে সামাজিক প্রক্রিয়ায় অপরাধ প্রতিরোধ জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। যদি এটি বেশি মাত্রায় কার্যকর হতো তাহলে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার তত প্রয়োজন হতো না। কিন্তু সেটি সঠিকভাবে কাজ করছে না বিধায় বিকল্প ব্যবস্থা, যার নাম শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন। কিন্তু যিনি শাস্তিই পাচ্ছেন না তিনি কী করে সংশোধন হবেন? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশে সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিবিধ আইন রয়েছে। সর্বর্শেষ পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। আইনি কাঠামোর এ ব্যর্থতার দায়ভার কে নেবে? এখন সময় এসেছে নতুনভাবে চিন্তা করার, না হলে আবারও আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যেতে হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments