ডাক্তারদের বিসিএস ও নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু কথা by ওয়াহিদ নবি

২০১১ সালের জুন মাসে যাঁরা বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেছিলেন সেসব ডাক্তার এখন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করার পর বেশ কিছুদিন তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। এখন যাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছেন তাঁরা ২০১০ সালে এমবিবিএস পাস করেছেন।
তাঁরা ২০১১ সালে ইন্টার্নশিপ করেছেন। তাঁরা প্রিলিমিনারি বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২০১২ সালের জুন মাসে। প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে পাস করেছেন প্রায় ২৭ হাজার। লিখিত পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। ফলে ৭ অক্টোবরে পরীক্ষা না হয়ে ১৮ ডিসেম্বর পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পরীক্ষা হওয়ার তিন মাসের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। এরপর অনুষ্ঠিত হবে মৌখিক পরীক্ষা। ফল বেরোবে সম্ভবত তার দুই মাস পর। যাঁরা সফল হবেন তাঁদের পুলিশ ভেরিফিকেশন ও মেডিক্যাল পরীক্ষা হবে। এতে সাধারণত কয়েক মাস লাগে। এরপর ডাক্তাররা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন সব কিছু ঠিকমতো চললে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করার তিন বছর পর একজন ডাক্তার সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারেন।
যেসব সেবা ছাড়া মনুষ্য অস্তিত্ব বিপদসংকুল হয়ে পড়ে, চিকিৎসাসেবা তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। এ কারণে ডাক্তারদের দীর্ঘ প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একটি দেশের ভালো ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়ে। এখানেই শেষ নয়, একজন ডাক্তারকে আসলে কর্মজীবনেও লেখাপড়া করতে হয় এবং অবিরাম স্বপ্রশিক্ষণের ভেতরে থাকতে হয় সর্বশেষ জ্ঞান আহরণের জন্য। শুধু জ্ঞান আহরণ নয়, রোগীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাও একজন ভালো ডাক্তারের কর্তব্য। ডাক্তাররা অবশ্যই নিজের দায়িত্ব পালন করবেন। সমাজেরও উচিত এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে ডাক্তাররা অযথা হয়রান না হন বা নৈরাশ্যের শিকার না হন। দীর্ঘসূত্রতা বিরক্তির একটা বড় কারণ। এ জন্য বোধহয় ভেবে দেখা উচিত, কী করে ডাক্তারদের নিয়োগপ্রক্রিয়া একটু ছোট করা যায় এবং একটু দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। 'চলছে চলুক'- এ ধরনের মনোভাব কোনো কিছু সম্পর্কেই নেওয়া উচিত নয়। ডাক্তারদের নিয়োগপ্রক্রিয়ার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তো নয়ই।
এবার দেখা যাক কী কী বিষয় ডাক্তারদের পড়তে হয় বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। তাঁদের পড়তে হয় বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা সাহিত্য, ভাব সম্প্রসারণ, সারাংশ ইত্যাদি। এমবিবিএস পড়ার সময় সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি ইত্যাদি বিষয়ের আগে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি ইত্যাদি দুরূহ বিষয় পড়তে ও শিখতে হয়। রোগীদের সারিয়ে তোলার জন্য এসব শিখতে হয়। ভালোভাবে না শিখলে রোগীর জীবন নিরাপদ হবে না। এ অবস্থায় বাংলা সাহিত্য বা ব্যাকরণ পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে আসলেই ডাক্তারি করার জন্য বাংলা সাহিত্য পড়ার প্রয়োজন আছে কি না! ব্যাকরণ সম্পর্কেও একই প্রশ্ন। পড়তে পারলে ভালো। শিখতে পারলে আরো ভালো। কিন্তু সেটা সম্ভব কি না? সেটা প্রয়োজনীয় কি না? শুনেছি কাহ্নপদের চর্যাপদ, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা সম্পর্কেও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। ভাগ্যিস রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় না। আমরা এসব পড়েছি ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে, পরীক্ষা ইত্যাদির ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়ার পর। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যেসব জ্ঞানী চিকিৎসক পরীক্ষা নেন, তাঁরা কি ডাক্তারি পড়ার সময় এতটা বাংলা সাহিত্য পড়েছিলেন, যাতে তাঁরা ডাক্তার হওয়ার পর পরই বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারতেন?
আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তাঁরা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কী কী বই পড়েছিলেন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সময়। উত্তর পেয়েছিলাম বেশ মজার। তাঁরা সুকুমার সেন বা গোপাল হালদার অথবা দীনেশ চন্দ্র সেনের বই পড়েননি। শুনলাম যে অতীতের বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নের ভিত্তিতে কিছু বই লেখা হয়েছে, যেগুলো সবাই পড়ে। বাংলার মতো ইংরেজিও শিখতে হবে ডাক্তার বিসিএস পরীক্ষার্থীদের। তবে সাহিত্য পড়তে হয় না। কাহ্নপদের ইংরেজি রূপ ভেনারেবল বিড পড়তে হয় না। চসার থেকে এলিয়ট পড়তে হয় না। ইংরেজি ব্যাকরণ পড়লেই চলে। যেসব ডাক্তার পরীক্ষক পরীক্ষা নেন তাঁরা কী ভাবেন তা জানতে ইচ্ছা করে। বিসিএস পরীক্ষায় যাঁরা অঙ্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁদের হিসাব কি ঠিক আছে?
শুনলাম যে পরীক্ষার্থীদের পড়তে হয় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান। 'আমার আর কিছুই বলার নেই'। ডাক্তারদের শুধু সাহিত্যিক হলেই চলবে না, তাঁদের সংবিধান বিশেষজ্ঞও হতে হবে। চিকিৎসা করলেই শুধু চলবে না, আইনজ্ঞও হতে হবে। এক বন্ধু রসিকতা করে বলেছিল, 'বিশেষজ্ঞ কথাটার মানে হচ্ছে বিশেষভাবে অজ্ঞ'। বহু বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কী বলা হবে জানি না।
একটি বইতে বিশেষজ্ঞের সংজ্ঞা পড়েছিলাম, 'They know more and more about less and less'('তাঁরা বেশি বেশি জানেন কম কম বিষয় সম্বন্ধে')। আমাদের ডাক্তারদের বিসিএসের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা জানবেন 'They will know more and more about more and more' (তাঁরা বেশি বেশি জানবেন বেশি বেশি বিষয় সম্পর্কে)। তাঁদের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল।
শুনেছি, দুদকের কথা আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাও নাকি পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করা হয়। দুর্নীতি দমনে হিমশিম খাচ্ছে সবাই, কারণ নাকি 'সরিষায় ভূত'। বেচারা ডাক্তাররা দুদকের কথা জেনে কী করবেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির চিরাচরিত ঝগড়া। তত্ত্বাবধায়ক সেনাশাসিত সরকার হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তা কে হবেন? এক নম্বর না হলে কে ২ নম্বর হবেন। দুই নম্বর না হলে হবেন ৩ নম্বর। এভাবে কত দূর চলতে পারে কে জানে! চলতে চলতে নাকি যে কেউ কর্তা হতে পারেন। এসব ডামাডোলের মধ্যে ডাক্তারদের না নিয়ে গেলেই ভালো হতো।
আবার নাকি আছে আন্তর্জাতিক বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যাওয়ার পর ডাবি্লউ এমডির কী হলো এটা খোঁজার জন্য ডাক্তারদের না লাগানোই ভালো। আফগানিস্তানে আর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা পাঠিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এবার ইরানের ব্যাপার জেনে ডাক্তাররা সেখানে গিয়ে কিছু করুক এটা যেন কারো ইচ্ছে না হয়।
আসলেই ডাক্তারদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটি খুবই মন্থরগতির। এটাতে কিছু গতি সঞ্চারের প্রয়োজন রয়েছে। মাল্টিপল চয়েস পরীক্ষা বেশ বিজ্ঞানসম্মত। জ্ঞানের পরীক্ষার জন্য এই পরীক্ষা যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, এ পরীক্ষা নৈর্ব্যক্তিক। এ পরীক্ষা ব্যবহার করলে আরেকটি লিখিত পরীক্ষার দরকার হয় না। যেহেতু হরতাল, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অন্যান্য কারণে পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলোর কথাই শুধু মনে রাখা উচিত। মৌখিক পরীক্ষাটি না থাকলেই কি নয়? অনেকে বলবেন, মৌখিক পরীক্ষা দ্বারা প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, উপস্থিত বুদ্ধি, সৌজন্যবোধ ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া যায়। অস্কার ওয়াইল্ডের কথা মনে পড়ে যায়, 'কর্তব্য পালনের বিষয়টি অন্যের ব্যাপার। কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে, পরীক্ষকের পক্ষে নৈর্ব্যক্তিক হওয়া সম্ভব নয়। যদি মৌখিক পরীক্ষা থাকতেই হয়, তবে এটাকে নৈর্ব্যক্তিকের চেষ্টা করা উচিত।
এত কিছুর পর একজন ডাক্তার শুধু কনিষ্ঠ ডাক্তার হিসেবে চাকরি পান (সম্ভবত রুরাল হেলথ সেন্টারে)। এরপর শুরু হবে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য তাঁর চিন্তাভাবনা ও চেষ্টা। জীবনের আরো কয়েকটি বছর কেটে যাবে। আমরা শুধু চিকিৎসক হিসেবেই তাঁকে দেখছি। কিন্তু তাঁর রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন। আছে পারিবারিক জীবন।
চিকিৎসা পেশায় নিষ্ঠা অবশ্যই প্রয়োজন। একজন ডাক্তারের যাতে পেশার কারণে পারিবারিক জীবন ব্যাহত না হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব সমাজের। যদি সমাজ এসব দিকে নজর না দেয়, তবে একদিন না একদিন চিকিৎসা পেশা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে ভালো ছেলেমেয়েরা।

লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টে ফেলো

No comments

Powered by Blogger.