কথা ও বাস্তবতার মধ্যে কোনো মিল নেই by মাহমুদুর রহমান মান্না

৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ১১ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। হিসাবমতো নির্বাচনের বাকি আর এক বছর। সেই বিবেচনা প্রধানমন্ত্রীর ২৯ মিনিটের বক্তৃতায় সব ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়েছে।
শুরুতেই তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, 'চার বছর পর আজ আমরা গর্বভরে বলতে পারছি, নির্বাচনের প্রাক্কালে যেসব অঙ্গীকার আপনাদের কাছে দিয়েছিলাম, নানামুখী প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্যের চেয়েও বেশি অর্জন করেছি।' সামনের দিনগুলোতেও সর্বস্তরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি সূচক ইতিবাচক ধারায় এগোচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। 'বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল' বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তৃতা এবং এখানে উলি্লখিত তাঁর শেষ বাক্যটি আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।
সম্ভবত আমাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এ রকম যে আমরা খুব মেপে মেপে হিসাব করে কাজ করতে পারি না, কথা বলতে পারি না। যখন বলি, তখন সব ভালো বলি, সবচেয়ে ভালো বলি। নয়তো সব খারাপ, সবচেয়ে খারাপ বলি।
বাংলাদেশের বয়স এখন ৪১ বছর। এই ৪১ বছরে যে বাংলাদেশ এগিয়েছে সে কথা কোনো মূর্খ অস্বীকার করবে না। ইউরোপের কোনো কোনো দেশ ও সংস্থা সেটি উল্লেখ করেছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এও বলেছেন যে মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
গত দুই দশকের কথাই ধরা যাক। এই সময়কালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি চার শতাংশের নিচে থেকে ছয় শতাংশের ওপরে উঠে এসেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে তুলনামূলক আরো বেশি হারে। এখন তা বছরে ৮০০ ডলার বা ৬৪ হাজার টাকার বেশি। এসবের পেছনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ একটি সাহায্যনির্ভর দেশ থেকে বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে। পণ্য ও সেবা খাতের রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি জিডিপিতে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ প্রায় ছয় শতাংশ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে দুই শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পণ্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে নিট বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পরিমাণ বর্তমানে আমরা বার্ষিক যে সাহায্য পাই, এর চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি। চীনের পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল। তা ছাড়া জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, বস্ত্র, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ মাছ ও কৃষিপণ্যের মতো বিভিন্ন খাতের রপ্তানিতেও দেশ এগিয়েছে। অন্যদিকে কৃষি উৎপাদনে আমাদের অগ্রগতি বিস্ময়কর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে বর্তমানে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ভিতকে শক্তিশালী করেছে এবং খাদ্য আমদানির অপরিহার্যতা দূর করেছে। এ ছাড়া শিক্ষা খাতে বিশেষ করে নারী শিক্ষার অগ্রগতি এবং শিশু মৃত্যুর হার কমে আসাসহ স্বাস্থ্যসেবা খাতেও এগিয়েছে দেশ। বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু।
কিন্তু এ থেকে কি বাংলাদেশকে বিশ্বে এখন উন্নয়নের একটি রোল মডেল বলা যায়। রোল মডেল শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক ও গভীর একটি-দুটি সূচকে ভালো করলেই সব সূচকের কথা বলা যায় না। প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকে। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ বিরোধী দলও যখন কথা বলে তখন মনে হয়, যা কিছু কৃতিত্ব তা তাদেরই প্রাপ্য। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, বাংলাদেশের যেটুকু অগ্রগতি, এর জন্য ৪১ বছরে বিশেষ করে গত দুই দশককে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি লক্ষ্য ছিল, সবার জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের হার কমেছে কিন্তু সংখ্যা কমেনি। যে উন্নয়নের সূচক আমরা দেখাচ্ছি, তাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স।
শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বিস্তার ঘটলেও এর মান ঠিক থাকছে না। তাই আশানুরূপভাবে সাধারণ মানুষ লাভবান হচ্ছে না। কোনো ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে, যার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ বিষয়েও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। ফলে মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা বেড়ে চলেছে। জনসম্পৃক্ত প্রতিটি খাতেই এমন অবহেলা স্থায়ী হয়ে উঠেছে।
রাজনীতির দায়িত্ব হচ্ছে বিদ্যমান সংকটের বাধা দূর করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখা। এ লক্ষ্যেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এসব আন্দোলনে বিজয়ী হলেও জনগণ কাঙ্ক্ষিত ফললাভ করেনি। কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং সামগ্রিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। রাজনীতি যথাযথ দায়িত্ব পালন দূরে থাক, এখন রাজনৈতিক সংকটই প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট গভীরতর হয়ে মহাসংকটের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলায় ভরে উঠেছে সারা দেশ। সব কিছুই মুখ থুবড়ে পড়ার জোগাড়। ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষ হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। কুইক রেন্টালসহ বিভিন্ন খাতে লুটপাটের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে সরকারের ভর্তুকি। তা পূরণ করতে ব্যাংক ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য; ব্যাহত হচ্ছে শিল্প ও কল-কারখানার উৎপাদন। মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প পর্যন্ত দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। শেয়ারবাজার, রেলওয়ে, হলমার্ক, ডেসটিনি কেলেঙ্কারির মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের শেষ নেই। এসবের কারণে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে সামাজিক শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ২৯ মিনিটের বক্তৃতায় রাজনীতি নিয়েও কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা শুধু তাঁর কথা। আগামী নির্বাচন নিয়ে যে বিরোধী দলের সঙ্গে সংঘাতের অবস্থা, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি। সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। মানুষ তাই এখনো অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। সবাই স্বীকার করবেন, এ অবস্থা সুস্থ বিনিয়োগ বা অর্থনীতি বিকাশের কথা বলে না।
সরকারকে ভয়ানক অধৈর্য মনে হচ্ছে। কোনো রকম বিরোধিতা সহ্য করতে পারছে না। মাধ্যমিক শিক্ষকদের ন্যায়সংগত দাবি পেশ করার জন্য কোথাও বসতে পর্যন্ত দেয়নি। তাঁদের চোখে ঢেলে দিয়েছে বিনষ্টকারী পিপার স্প্রে। বামপন্থীরা যে হরতাল ডেকেছিল তাদের নেতাদের চোখেও একই অমানবিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে তারা। মজার ব্যাপার, এই বামপন্থীরাই গত মাসে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে হরতাল ডেকেছিল। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক মডেল হয়ে থাকতে পারে। সেই বামপন্থীরাই যখন ১৬ জানুয়ারি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল ডাকল, তখন তাদের মেরে তক্তা বানিয়ে দেওয়া হলো। তেলের মূল্যবৃদ্ধির কি কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে? 'বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দাবি যে কতখানি অযৌক্তিক, তা এখন সবাই জানে। পদ্মা সেতু এ সরকারের আমলে যে আর হবে না, সে কথা সরকারেরই অংশীদার এরশাদ বলেছেন। এ কেমন রোল মডেল শেখ হাসিনার।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.