আওয়ামী লীগ ও সশস্ত্র বাহিনী ব্যারিস্টার by মোহাম্মদ আলী

দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই সশস্ত্র সংগ্রাম যেমন ছিল সাত কোটি বাঙালীর মর্মস্পর্শী আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহির্প্রকাশ, তেমনি তা ছিল পুরোপুরি সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত।
এই সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সর্বশ্রেণী ও পেশার জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণ আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করে তা অতি দ্রুত কাঙ্তি ল্যে পেঁৗঁছতে সাহায্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ডাকে ছাত্র-জনতা প্রথম বেরিয়ে এসেছিল এবং তাদেরই পথ অনুসরণ করে সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনীর অনেক তাজা প্রাণ দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াই করেছে। আর এ থেকেই বোঝা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা আওয়ামী লীগের সাথে সশস্ত্র বাহিনীর সৌহার্দ্য ও আত্মিক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্ম থেকেই। আওয়ামী লীগ কখনই সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর স্বার্থবিরোধী নয়। এতদসত্ত্বেও কতিপয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সমস্ত বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগবিদ্বেষী গুজব ও অপপ্রচার স্বাধীনতার পর থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে চালিয়ে আসছে। ১৯৭৫-এর পরে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত দু'বার মতায় এসেছে এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত একবার পূর্ণ মেয়াদে দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু আমরা সরকারের ভারতপ্রীতির এ ধরনের অপ্রপ্রচারের কোন সত্যতার প্রমাণ পাইনি এবং বাংলাদেশ ভারতের ত্াবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি।
স্বাধীনতার ২৫ বছর পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন এবং প্রতিরামন্ত্রী হিসাবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উন্নতিকল্পে সার্বণিক সচেষ্ট ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৯৬ সালে সৈনিকদের দুপুরে রুটির বদলে ভাতের ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে মেজর পদবির সকল অফিসারের বাসা ও অফিসে টেলিফোনের ব্যবস্থা করেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সকল সেনা সদস্যের পিতা-মাতা এবং শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ মিশনে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে ব্রিগেড আকারে সৈন্য প্রেরণ শুরু হয়। বর্তমানে ৯টি দেশে, ১০টি মিশনে ৮৩৬৯ সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করছে এবং এ পর্যন্ত মোট ৮০ হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য বিভিন্ন শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালন করেছে। বিভিন্ন জাতিসংঘ শান্তি মিশনে চাকরিরত সেনা সদস্যদের সংখ্যার বিপরীতে অতিরিক্ত শতকরা ৫০% পদে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সেনা ইউনিটে যানবাহনের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়। ১৯৯৭ সালে ১২টি সৈনিক কোয়ার্টার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সাথে সৈনিক ও অফিসারদের পারিবারিক বাসস্থানের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ ও চারতলা ভবনগুলোকে ৫ তলায় উন্নীত করে ৪০০টি নতুন বাসস্থান তৈরি করা হয়। ১৯৯৭ সালের ০২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনন্দিত হয়। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ। ঐ একই সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত হয় মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) ও আর্মড ফোর্সের মেডিক্যাল কলেজ। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিরীদের প্রশিণের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশেন ট্রেনিং। ১৯৯৬ সালে বান্দরবানে ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ এবং কক্সবাজারে এয়ার ডিফেন্স ফায়ারিং রেঞ্জ গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৭ সালে সার্জেন্ট তদনিম্ন কর্মচারী এবং বেসামরিক কর্মচারীদের জন্য টিফিন ভাতা চালু করা হয়। ২০০০ সালে সেনাবাহিনীর অন্যান্য পদবির নামকরণ আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানে সমন্বয় করা হয়। ১৯৯৯ সালে ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং একই বছরে হোটেল র্যাডিসন-এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে সেনাবাহিনীতে হস্তান্তর করা হয। এখন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান থেকে সেনাবাহিনীতে ২৮৩৭টি যানবাহন সরবরাহ করা হয়। ১৯৯৯ সালে ২য় পদাতিক রেজিমেন্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ২য় বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট। ২০০০ সালের ১ জুন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এলাকা সিলেটে একটি নতুন পদাতিক ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর নিরাপত্তায় ১৯৯৯ সালে একটি কম্পোজিট ব্রিগেড স্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালে নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য যুক্ত করা হয় যুদ্ধ জাহাজ 'বরকত।' ১৯৯৭ সালে কমিশন্ড হয় নৌবাহিনী যুদ্ধ জাহাজ 'ইমাম গাজ্জালী।' ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সর্বাধুনিক পেট্রোল ক্রাফট 'বা নৌ জা মধুমতি' নৌবাহিনীর অন্তভর্ুক্ত হয়। ২০০০ সালে যুক্ত হয় আরও দু'টি নতুন পেট্রোল ক্রাফট 'বা নৌ জা তিতাস' এবং 'কুশিয়ারা।' ২০০০ সালে কোস্টগার্ডে যুক্ত করা হয় 'সিজিএস রূপসী বাংলা।' ১৯৯৯ সালে নৌ সেনাদের সু-চিকিৎসার জন্য বা নৌ জা উপশমকে খুলনা নেভাল কমান্ডের অন্তভর্ুক্ত করা হয়। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওডদমমফ মত ুটরর্ধধবণ ঘটরতটরণ ্ কটর্ডধড্র। ২০০০ সালে খুলনা শিপইয়ার্ডকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০০ সালের ২০ জুন মিসাইল ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম যুক্ত 'বা নৌ জা বঙ্গবন্ধু' কমিশন লাভ করে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয় প্রশিণ বিমান টি-৩৭ এবং জঙ্গী বিমান এফটি-৭। ১৯৯৭ সালে সংযোজিত হয় বেল-২১২, এমআই-১৭ এবং বেল-২০৬ হেলিকপ্টার। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে বগুড়া এবং মৌলভীবাজারে রাডার স্টেশন স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০১ সালে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে পৃথক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ফাইং ইউনিট গড়ে তোলা হয় এবং যুক্ত হয় ২টি সি-১৩০ পরিবহন বিমান। ২০০০ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান যুক্ত হয়। সম্প্রতি সেনাবাহিনীতে ২২ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ১০ জন কর্নেল, ২৪ জন লে. কর্নেল-এর নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। ফলে সেনাবাহিনীর জনবল ৫০০০ জন বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ শান্তিরা মিশনে বাংলাদেশের সৈন্য সাংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। ২০০৯ সালে 'বা নৌ জা বঙ্গবন্ধু'তে হেলিকপ্টার ও মিসাইল সংযোজনের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। ২০০৯ সালে সৈনিকদের রেশন স্কেল বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং দুপুরে ভাতের সাথে সৈনিকরা যাতে মাছ-মাংস খেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও ডিওএইচএস ও সেনাপল্লী গঠনের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) গঠনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এত বিশাল অবদান সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য যে, দলটি এখন পর্যন্ত অনবরত ও সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের নানা অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে। সর্বশেষ গত বছর বিডিআরের নারকীয় হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। সদ্য গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার স্থিতিশীল হবার ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিডিআর বিদ্রোহে ৫৬ জন সেনা কর্মকর্তার নিষ্ঠুর মৃতু্যতে পুরো জাতি হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কতিপয় বিরোধী দলসহ অনেক স্বার্থান্বেষী মহল এ সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি ছিল না। সব দোষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রধানমন্ত্রীসহ আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতায় চেষ্টা ব্রতী মন্ত্রীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঢেলে দিতে চেয়েছিল। পুরো জাতি অজানা এক আশঙ্কায় সেসময় থর থর করে কাঁপছিল। সমঝোতার প্রচেষ্টা, না পাল্টা আক্রমণের প্রয়োজন ছিল তা নিয়ে শুরু হয় বিশাল বিতর্ক। কিন্তু শেখ হাসিনার বিচণতা, দৃঢ় মনোবল ও অনন্য সাহসিকতা গোটা জাতিকে রা করতে সম হয়েছিল। তিনি বিডিআর জোয়ানদের বিদ্রোহের ঘটনায় সাধারণ মা ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে হত্যা ও লুণ্ঠনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেন। বিডিআরের অনাকাঙ্তি ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ও উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেেিত সরকার অত্যন্ত বিচণতা ও দ্রুততার সাথে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিদ্রোহকালে বিদ্রোহীদের সাথে আলাপ আলোচনা ও সেই সাথে আত্মসমর্পণের নিদিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া, জাতির উদ্দেশে ভাষণ, শোকার্ত শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং বিশেষভাবে সেনাকুঞ্জে সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনা ও তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান প্রভৃতি কার্যকলাপ এক অসাধারণ সরকারপ্রধানের পরিচয় বহন করে।
আওয়ামী লীগ একটি দেশপ্রেমিক গণমুখী সংগঠিত দল। এই দলের সরকার সশস্ত্র বাহিনী ও সাধারণ জনগণের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে কখনই লিপ্ত হবে না। কেননা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পথ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীই ত্বরান্বিত করেছে। দলমত নির্বিশেষে জাতীয় সংগঠন বিশেষত সশস্ত্র বাহিনীকে কোন সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে টানাটানি করা কারও কাম্য হতে পারে না। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচারে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক এবং প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাক এটাই আমাদের কাম্য। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদা তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতার অবারিত দ্বার উন্মোচন করে রেখেছেন।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.