সে আমার ছোট বোন... by রবীন আহসান

১৯৯৩ সাল থেকে কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে লেখক শিবির, তৃণমূল পত্রিকা নিয়ে অনেক আড্ডা, অনেক স্মৃতি। সাদা চুল ওয়েস্টার্ন নায়কদের মতো দেখতে। লাল চেক শার্ট। সবসময়ই কালারফুল পোশাক পরতেন ইলিয়াস ভাই। পা ব্যথা পা ব্যথা হতে হতে তা রূপ নেয় বোন ক্যান্সারে।
কলকাতার হাসপাতালে মাথাভরা সাদা চুল ও এক পা হারিয়ে ঢাকায় আসেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী ইলিয়াস ভাই আমাকে বলেন, রবীন দুটি বছর বাঁচতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর উপন্যাস 'করতোয়া মাহাত্ম্য' লিখে শেষ করতে পারব। আমার কিছু দিন বগুড়ায় থাকতে হবে। 'করতোয়া মাহাত্ম্য'র থিম নিয়ে ইলিয়াস ভাই আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেন। আমি তাকে বলি, ইলিয়াস ভাই আপনি বাঁচবেন। 'করতোয়া মাহাত্ম্য' উপন্যাসের জন্যই আপনাকে বাঁচতে হবে। এই কথোপকথনের দুই মাসের মধ্যেই ঢাকার একটি সাধারণ হাসপাতালে মৃত্যু হয় বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কথাশিল্পীর। সারারাত তার পাশে ছিলাম। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই এই জীবনবিনাশী অসুখের কাছে।
ঢাকা শহরের গত ২০ বছরে পার্টি অফিসের টেবিলে ঘুমিয়েছি কয়েক বছর। তারপর মেস জীবন, দুই ব্যাচেলর মিলে মহিউদ্দীন আর আমি একটা ছোট পরিবারের সঙ্গে আলাদা এক রুম নিয়ে থাকতাম। মহিউদ্দীন তার ভাইয়ের ওষুধের দোকান চালাত মিরপুর এলাকায়। ওষুধের দোকান মানেই মহিউদ্দীনও ছোটখাটো ডাক্তার, এলাকার লোকজনের জ্বর, কাশি হলে মহিউদ্দীন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের প্যারাসিটামল ওষুধ দিত। মহিউদ্দীনের দু'চারদিন পরপর জ্বর, কাশি লেগে থাকত আর সে নিজেই গিলত বিভিন্ন ধরনের প্যারাসিটামল। রাত ১২টা, ১টায় আমি বাসায় ফিরতাম । রাত ২টা, ৩টা পর্যন্ত আমরা দেশ, সাহিত্য, সিনেমা নিয়ে গল্প করতাম। মাঝে মধ্যে শুক্রবার আমরা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। একদিন মহিউদ্দীন রাতে আমার ওপর ক্ষেপে গিয়ে বলে, 'রবীন ভাই আপনার বিয়ের তো কোনো খবর নাই, কোনো আওয়াজও শুনি না। আপনারে বিয়া করবে কে? রাতে ১টা, ২টায় বাসায় ফেরেন, ঘুমান ১১টা, ১২টা পর্যন্ত, একটা দিন বাজার করেন না। আপনার লগে থাইকা আমি দিন দিন বাউল হইয়া যাইতেছি। আপনার লগে থাকলে আমার আর জীবনে বিয়া হইবে না।' মহিউদ্দীন কাশতে থাকে আর কাশতে থাকে। আমি সচরাচর কাউকে উপদেশ দেই না। আমি নিজে ও ছোটবেলা থেকেই উপদেশ শুনতে অভ্যস্ত নই। কিন্তু মহিউদ্দীনের একটু পরপর কাশি আমার কাছে অন্য বার্তা নিয়ে আসে। আমি বিছানায় হাত-পা উঠিয়ে বড় ভাইসুলভ আচরণের মতো করে বলি, ডাক্তার মহিউদ্দীন সাহেব প্যারাসিটামল খাওয়া বন্ধ কইরা একটা বড় ডাক্তার দেখান, টাকাপয়সা জমাইয়া কবরে যাইয়েন না। ততদিনে মহিউদ্দীনের পুরো শরীরটা ক্যান্সারে ছেয়ে গেছে। ওষুধ বিক্রেতা মহিউদ্দীন হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ মহিউদ্দীন এসবের কিছুই জানত না। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় কলকাতার এক হাসপাতালে মহিউদ্দীনের মৃত্যু হয়।
আমাদের বন্ধু লীনা একবারও বলেননি ওর ক্যান্সার হয়েছে। ওকে একবার বসুন্ধরা মার্কেটে ববচুল কাটা দেখে বলতে চেয়েছিলাম, আপনার সুন্দর চুলগুলো হঠাৎ এ রকম কাটলেন ক্যান? বলা হয়নি। একদিন সকালবেলা মোবাইলে দেখি সাংবাদিক ফারজানা রূপার এসএমএস, প্রথম আলোর নারীমঞ্চে ওদের একটা লেখা ছাপা হয়েছে তা পড়ার জন্য। দোকান থেকে একটা প্রথম আলো আনাই। লীনার ভয়াবহ ক্যান্সারের সংবাদ পড়ে হতভম্ব হয়ে যাই। লীনা এখনও ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু আজিজ মার্কেটের সুরের মেলার রূপকার রিয়াজ ভাই হাসিখুশি, আড্ডাবাজ, বুদ্ধিদীপ্ত রিয়াজ ভাই মাত্র দুই বছরের মাথায় ক্যামোর পর ক্যামো, ঢাকা থেকে বোম্বাই_ বোম্বাই থেকে ঢাকা ক্যান্সারের সঙ্গে লড়তে লড়তে পরাজিত হয়েছেন। তিন মাস আগে কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমেরিকায় চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসে তার লাশ।
আমার প্রিয় দুই নেতা ফিদেল কাস্ত্রো-হুগো শাভেজ শরীরের ক্যান্সার নিয়ে লড়াকু জীবনযাপন করছেন দেখে আমিও আশাবাদী হই আমার প্রিয় বোনটার জীবন নিয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি, ও বেঁচে আছে, ওর শিশুসন্তান দুটি বড় হচ্ছে মায়ের হাত ধরে। মেয়ে হয়ে জন্মের কারণে বাপের বাড়িতে ও সুখী ছিল না, সুখী ছিল না শ্বশুরবাড়িতেও । খুব অল্প বয়সে ওর বিয়ে হয়। আর আমি ঘরের বড় ছেলে হিসেবে মাছের মাথাটা খেতাম। এসব অপরাধবোধ এখন আমার মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করে। বড় ভাই হিসেবে আমিও ওদের কোনো দায়দায়িত্ব পালন করিনি। আমি শিল্পী পল গগাঁর মতো ছবি আঁকব বলে এক সময় ঘর-সংসার ছেড়ে পালাতে চেয়েছি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস রাস্তায় রাস্তায়, মিছিলে ঘুরে বেরিয়েছি। মুদ্রণ, গ্রাফিক্স ডিজাইন পারদর্শী আমি কাজকর্ম ফেলে এখনও আড্ডা দিতেই বেশি ভালোবাসি। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোট বোনটার সঙ্গে আমার কথা হয় না খুব একটা। ওর হাসি হাসি চেহারাটা এখন বদলে গেছে, পৃথিবীর কোনো মানুষের এই রূপ আমি দেখতে চাই না। ডাক্তাররা প্রথমে যা বলেছিলেন তাতে খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না। চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় ওর চিকিৎসা সম্ভব ছিল, আমরা তার ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু দ্রুত বদলে যায় ওর শরীর। শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে ক্যান্সার।
আমাদের সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে আসে, চিকিৎসার আরও টাকা চাই ওর জন্য। ওর জন্মের পর ওকে ধরে এত কান্নাকাটি করিনি আমি। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, দাদা, আমি বাঁচতে চাই। আমারে তোরা বাঁচা। আজ আমিও পথে নেমেছি আমার এই বোনটাকে বাঁচানোর জন্য। ওর ফুটফুটে শিশু দুটির ভবিষ্যতের জন্য আমিও হাত বাড়িয়েছি মানুষের মাঝে। সাথীকে বাঁচতে সাহায্য করুন, যার যতটুকু সাধ্য আছে তাই দিয়ে। প্রতিদিন সূর্য উঠুক_ ঘুম ভাঙবে বলে।
আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঠিকানা : ডাচ্-বাংলা ব্যাংক
সাদিকা নুসরাত
অ্যাকাউন্ট নং-১৬৪. ১০১. ২১৩ ৪৮৫
(ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের যে কোনো শাখায় ওই অ্যাকাউন্ট নম্বরে টাকা জমা দেওয়া যাবে)
পুনশ্চ : খাদ্যে বিষক্রিয়া মিশিয়ে যারা সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য ব্যাধি তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। গণমাধ্যমে ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান চাই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের আরও চিকিৎসা বিষয়ক লেখালেখি প্রয়োজন।

রবীন আহসান : ছড়াকার, প্রকাশক

No comments

Powered by Blogger.